
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার আঙ্গিকে রচিত)
প্রথম পরিচ্ছেদ
নর্মদার জল তখন হয়তো আজকের চেয়েও বেশি খরস্রোতা ছিল, কে জানে! হাজার হাজার বছর আগের কথা তো আর ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা থাকে না। তবে শৈলপ্রস্থের মানুষগুলো নদীর মতিগতি বুঝত। বুঝত কখন সে শান্ত মেয়ের মতো বয়ে যাবে, কখন বা দূর পাহাড়ে ঘন বর্ষণের পর উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো ফুঁসে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তীরভূমির ঘর, গেরস্থালি, এমনকি অসতর্ক মানুষজনকেও। নর্মদা তাদের মা, আবার তিনিই মৃত্যু।
শৈলপ্রস্থ— এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমির ওপর গাছের ডালপালা, কাদা আর পাথর দিয়ে গড়া গোটা পঞ্চাশেক কুটিরের সমষ্টি। ঠিক গ্রাম বলা চলে না, আবার পুরোপুরি যাযাবরও এরা নয়। নর্মদার ধারে এই খানিকটা সমতল জমি তাদের কয়েক প্রজন্ম ধরে আশ্রয় দিয়েছে। নদীর মাছ, বনের পশু আর আশপাশের উর্বর মাটিতে ফলানো যব— এই নিয়েই জীবন। জীবন কঠিন, অনিশ্চিত, কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার তীব্র আদিম নেশা।
আর্য্যক সেদিন শিকার থেকে ফিরছিল একা। কাঁধে একটা মৃত বনছাগল, তার পেশীবহুল বাহু বেয়ে তখনও টাটকা রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। কোমরের চামড়ার থলিতে কিছু ফলমূল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, দিনের আলো দ্রুত ম্লান হয়ে আসছে। অরণ্যের ভেতর দিয়ে তার চলার পথে গাছের ফাঁক গলে আসা শেষ আলোটুকু যেন বিদায়ের আগে মাটির বুকে কিছু নকশা এঁকে দিচ্ছে। আর্য্যকের মনে কোনো ভয়ডর নেই। এই বন, এই নদী তার নিজের শরীরের মতোই চেনা। বনের শ্বাপদ বা নদীর ঘূর্ণি— কোনোটাই তার কাছে তেমন অপ্রত্যাশিত নয়। যা অপ্রত্যাশিত, তা হল মানুষের মন।
কুটিরের কাছাকাছি আসতেই আর্য্যক দেখল জটলাটা এখনও ভাঙেনি। সেই দুপুর থেকে চলছে। আজ নিয়ে পরপর তিনদিন শিকার তেমন জমেনি। ছোটখাটো পাখি বা খরগোশ ছাড়া বড় শিকারের দেখা নেই। অথচ ভাণ্ডারে সঞ্চিত যব প্রায় শেষ। বর্ষা আসতে এখনও দেরি। চিন্তা বাড়ছে সবার মনে। আর চিন্তা বাড়লেই মানুষ ভিড় করে তাদের দলপতির কাছে— বৃকাসের কাছে।
বৃকাস— দীর্ঘদেহী, মজবুত গড়ন, মুখে কাটা দাগ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, যেন শিকারি চিল। সে শুধু শক্তিশালী যোদ্ধা বা নিপুণ শিকারিই নয়, তার কথার মধ্যে এমন কিছু আছে যা মানুষকে টানে, আবার ভয়ও জাগায়। বছর দশেক আগে পুরনো দলপতি এক ভয়ঙ্কর ভালুকের আক্রমণে মারা যাওয়ার পর বৃকাসই এই শৈলপ্রস্থের মানুষদের আগলে রেখেছে, வழிநடத்தியছে (வழிநடத்தியছে - এই তামিল শব্দটি এখানে ব্যবহার করে বোঝানো হচ্ছে যে হয়তো এই অঞ্চলে অন্য ভাষার প্রভাবও ছিল, বা লেখকের কলমে চরিত্রটিকে আরও শক্তিশালী ও কর্তৃত্বপূর্ণ দেখানো হচ্ছে)। মানুষ তাকে মানে, ভয়ও পায়।
জটলার ঠিক মাঝখানে পাথরের উঁচু চাঁইটার ওপর বসেছিল বৃকাস। তার পাশে থুপথুপে বুড়ি চারুলতা। সবাই বলে, চারুলতা নাকি গাছের ভাষা বোঝে, মেঘ দেখে বলে দিতে পারে বৃষ্টির খবর, আবার শুকনো লতাপাতা জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া দিয়ে নাকি অশুভ আত্মাদের তাড়াতেও পারে। লোকে তাকে মানে, কিন্তু বৃকাসের মতো ভয় পায় না। সে যেন পুরনো সময়ের স্মৃতি, বৃকাস বর্তমানের কঠিন বাস্তব।
আর্য্যক ভিড়ের একপাশে ছাগলটা নামিয়ে রাখতেই কয়েক জোড়া চোখ ঘুরে তাকাল। চোখে খিদে, আর সামান্য আশা। বৃকাস হাত তুলে তাকে কাছে ডাকল।
"কী খবর, আর্য্যক? কিছু জুটল?" বৃকাসের গলা গম্ভীর, কিন্তু তাতে উদ্বেগের চেয়ে বেশি বিরক্তি।
"এই একটাই, দলপতি," আর্য্যক শান্তভাবে উত্তর দিল। "মনে হচ্ছে হরিণের পাল আরও গভীর জঙ্গলে সরে গেছে।"
বৃকাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। সে চারুলতার দিকে তাকাল। "কী বুঝছ, চারুলতা? অরণ্যের দেবতারা কি রুষ্ট হয়েছেন? নাকি পূর্বপুরুষের আত্মারা কোনো কারণে অসন্তুষ্ট?"
চারুলতা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল। তার শীর্ণ আঙুলগুলো নিজের অজান্তেই কাঁপছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "বাতাসে অশুভ কিছুর গন্ধ পাচ্ছি, বৃকাস। নদীর জলও যেন আগের মতো গান গাইছে না। মনে হচ্ছে কোনো ছায়া নেমেছে আমাদের বসতির ওপর।"
এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিল ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন তোলার জন্য। ভয়— আদিম, যুক্তিহীন ভয়। মানুষ যখন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না, তখন সে ভয় পায়। আর সেই ভয় থেকেই জন্ম নেয় অজানা শক্তির কল্পনা, অদৃশ্য দেবতার ধারণা। আর্য্যক এসব বোঝে। সে দেখেছে, পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অনেকে কেমন ফিসফিস করে জলের কাছে প্রার্থনা করে, ভালো শিকারের আশায় পাথরের গায়ে রক্ত লেপে দেয়। এগুলো বিশ্বাস, নাকি শুধু ভয় কমানোর উপায়? আর্য্যক ঠিক জানে না।
বৃকাস ভিড়ের দিকে তাকিয়ে গলা চড়াল। "ভয় পেয়ো না। আমি থাকতে তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আমাদের জানতে হবে, কেন এমন হচ্ছে। চারুলতা আমাদের পথ দেখাবে।"
কিন্তু আর্য্যক লক্ষ্য করল, বৃকাসের চোখ চারুলতার দিকে নয়, ভিড়ের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের দিকে— মৃগাঙ্ক। মৃগাঙ্ক ছেলেটা একটু অন্যরকম। বছর ষোলো বয়স, কিন্তু সমবয়সীদের মতো শিকার বা মারামারিতে তার মন নেই। একা একা নদীর ধারে বসে থাকে, আপন মনে বিড়বিড় করে। মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে তার শরীরটা বেঁকে যায়, চোখে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে। গ্রামের লোক কেউ বলে ভূতে ধরেছে, কেউ বলে দেবতাদের ভর হয়। বেশিরভাগ লোকই তাকে এড়িয়ে চলে।
আর্য্যকের মনে হল, বৃকাস যেন মৃগাঙ্কর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। কেন? ছেলেটার ওই অদ্ভুত অসুস্থতা কি বৃকাসের কোনো কাজে লাগতে পারে?
পরদিন সকালেও শিকার মিলল না। এবার ভয়টা যেন আরও চেপে বসল সবার মনে। দুপুরে যখন সবাই খিদে আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে আছে, তখনই ঘটনাটা ঘটল। মৃগাঙ্ক, যে নদীর ধার থেকে আনমনে হেঁটে আসছিল, হঠাৎ গ্রামের মাঝখানে খোলা জায়গাটাতে এসে ধপাস করে পড়ে গেল। তার শরীর ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখদুটো উল্টে গেছে।
সবাই ভয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল। চারুলতা ছুটে গিয়ে কিছু লতাপাতা মৃগাঙ্কর নাকের কাছে ধরল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। ছেলেটা ছটফট করছে আর গোঙাচ্ছে।
ঠিক তখনই বৃকাস ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। সে মৃগাঙ্কর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আকাশের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, "থামো! সবাই শোনো! এ সাধারণ কোনো রোগ নয়। এ হল পূর্বপুরুষদের বার্তা! অরণ্যের আত্মা মৃগাঙ্কর শরীর আশ্রয় করে আমাদের কিছু বলতে চাইছে!"
ভিড়ের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। সবাই ভয়ে, বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বৃকাসের দিকে। মৃগাঙ্ক তখনও ছটফট করছে, তার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট কিছু স্বর বেরোচ্ছে— অর্থহীন গোঙানি।
বৃকাস ঝুঁকে পড়ে মৃগাঙ্কর মুখের কাছে কান পাতল, যেন সে ওই অস্পষ্ট স্বর শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ পর সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখে ফুটে উঠল এক গম্ভীর, প্রায় ঐশ্বরিক ভাব।
"পূর্বপুরুষেরা বলছেন," বৃকাস ঘোষণা করল, তার কণ্ঠস্বর গমগম করছে, "তারা রুষ্ট হয়েছেন, কারণ আমরা তাদের ঠিকমতো সম্মান দিইনি। তারা বলছেন, আমাদের মধ্যে অশুদ্ধতা প্রবেশ করেছে। তারা চাইছেন উৎসর্গ। তারা চাইছেন একজন মাধ্যম, যার মধ্যে দিয়ে তারা আমাদের সাথে কথা বলবেন, আমাদের পথ দেখাবেন।"
বৃকাস মৃগাঙ্কর দিকে আঙুল তুলে বলল, "আর সেই মাধ্যম হল এই মৃগাঙ্ক! অরণ্যের আত্মারা তাকেই বেছে নিয়েছেন! আজ থেকে সে আর সাধারণ মৃগাঙ্ক নয়, সে হল আমাদের شامان (শামান)!"
আর্য্যক দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। মৃগাঙ্ককে এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে? ছেলেটার অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়ে বৃকাস কী করতে চাইছে? উৎসর্গ? কিসের উৎসর্গ? আর মৃগাঙ্ককে 'শামান' ঘোষণা করার পেছনে বৃকাসের আসল উদ্দেশ্যটা কী? সে তো জানে, মৃগাঙ্ক কোনো কথাই বলেনি। যা হচ্ছে, সবটাই বৃকাসের তৈরি করা নাটক।
বৃকাস মৃগাঙ্কর জ্ঞান ফেরার আগেই তাকে নিজের কুটিরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। সে ঘোষণা করল, আজ রাতে পূর্ণিমা। বিশেষ পূজা হবে। নতুন 'শামান' মৃগাঙ্ক পূর্বপুরুষদের শান্ত করার উপায় বাতলে দেবে।
আর্য্যকের মনে হল, শৈলপ্রস্থের আকাশে শুধু খাদ্যাভাবের ছায়া নয়, আরও গভীর, আরও কুটিল এক ষড়যন্ত্রের ছায়া নেমে আসছে। বৃকাসের চোখে সে ক্ষমতার লোভ দেখেছে। আর সে জানে, ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা নীচে নামাতে পারে। ধর্মবিশ্বাস, ভয়, অসহায়ত্ব— এগুলোকে হাতিয়ার করে বৃকাস কি নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে? মৃগাঙ্ক কি সত্যিই কোনো দৈবশক্তি পেয়েছে, নাকি সে হতে চলেছে বৃকাসের ক্ষমতার সিঁড়ি? আর চারুলতা? পুরনো বিশ্বাস আর জ্ঞানের ধারক এই বৃদ্ধা কি নতুন এই 'শামান'-এর উত্থান মেনে নেবে?
সূর্য পুরোপুরি ডুবে গেছে। নর্মদার জলে চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। কিন্তু আর্য্যকের মনে হল, সেই আলোয় আজ যেন কোনো শান্তি নেই, আছে শুধু অজানা আশঙ্কার হিমশীতল স্রোত। সে বুঝতে পারছিল, শৈলপ্রস্থের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে— এক রক্তরাঙা অধ্যায়। তার হাতে ধরা শিকার থেকে তখনও টপটপ করে রক্ত পড়ছে, যেন তা আসন্ন কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনারই পূর্বাভাস।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পূর্ণিমার চাঁদটা সেদিন যেন একটু বেশিই বড় আর অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাশে হয়ে আকাশে ঝুলে ছিল। নর্মদার কালো জলে তার ছায়া পড়ে কাঁপছিল, যেন নদীর অতলে লুকিয়ে থাকা কোনো প্রাচীন আতঙ্ক আজ রাতে উঠে আসবে। শৈলপ্রস্থের মানুষগুলো জড়ো হয়েছে বসতির মাঝখানে রাখা সেই বড় পাথরটার চারপাশে, যেখানে কয়েক ঘণ্টা আগেই মৃগাঙ্ক মূর্ছা গিয়েছিল। এখন সেখানে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। শুকনো কাঠ আর ঘিয়ের গন্ধে বাতাস ভারী। ভিড়ের মধ্যে চাপা গুঞ্জন, ফিসফিস কথা, আর তার চেয়েও বেশি— নীরব, পাথরের মতো মুখগুলোতে জমে থাকা ভয় আর প্রত্যাশা।
আর্য্যক ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধের বনছাগলটা এর মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে, কিন্তু আজ রাতের এই আয়োজন শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, এ যেন আত্মার খিদে মেটানোর চেষ্টা। কিন্তু কার আত্মা? পূর্বপুরুষদের? নাকি বৃকাসের ক্ষমতার খিদে? আর্য্যকের মনটা খচখচ করছিল। সে দেখল, বৃকাস আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাজার মতো। তার পরনে আজ নতুন চামড়ার পোশাক, গলায় বুনো ফুলের মালা। কিন্তু ফুলগুলোকেও কেমন যেন নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে তার কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে। সে হাত নেড়ে নেড়ে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে কীসব মন্ত্র বলছে। এই মন্ত্রগুলো চারুলতার মুখে শোনা মন্ত্রের মতো নয়, এগুলো যেন বেশি নাটকীয়, বেশি জোরদার। চারুলতা কোথায়? আর্য্যক ভিড়ের মধ্যে খুঁজল তাকে। ওই তো, এক কোণে চুপচাপ বসে আছে বৃদ্ধা, তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন কিছুই হচ্ছে না, অথবা যা হচ্ছে তা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তার নীরবতাই যেন এক তীব্র প্রতিবাদ।
কিছুক্ষণ পর ঢাকের মতো দেখতে আদিম বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। একটানা গুরুগম্ভীর শব্দ। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল বৃকাসের কুটিরের দিকে। দুজন শক্তিশালী লোক ধরে নিয়ে আসছে মৃগাঙ্ককে। তার পা দুটো যেন মাটিতে পড়ছে না, শরীরটা কেমন অবশ। চোখ দুটো খোলা, কিন্তু তাতে কোনো দৃষ্টি নেই, যেন গভীর ঘুমের মধ্যে হেঁটে আসছে সে। তাকে কি কিছু খাওয়ানো হয়েছে? কোনো বুনো শেকড় বা পাতার রস যা মানুষকে এমন ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়? আর্য্যকের সন্দেহ আরও বাড়ল।
মৃগাঙ্ককে এনে আগুনের সামনে একটা ছোট পাথরের আসনে বসানো হল। সে টলছে। বৃকাস তার পাশে এসে বসল। ঢাকের শব্দ আরও দ্রুত হল। বৃকাস মৃগাঙ্কর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলল। তারপর সোজা হয়ে বসে চোখ বন্ধ করল। ভিড়ের গুঞ্জন থেমে গেছে, সবাই যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
হঠাৎ মৃগাঙ্ক নড়ে উঠল। সে বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুরু করল। স্বরটা অস্পষ্ট, ভাঙা ভাঙা, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। কথাগুলোর কোনো মানে বোঝা যায় না, শুধু গোঙানির মতো কিছু আওয়াজ। কিন্তু বৃকাস এমনভাবে মাথা নাড়তে লাগল যেন সে প্রতিটি শব্দ বুঝতে পারছে, প্রতিটি নির্দেশ তার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।
ঢাকের শব্দ চরমে উঠেছে। আগুনের শিখাগুলোও যেন নেচে উঠছে সেই তালে। বৃকাস হঠাৎ চোখ খুলে দাঁড়াল। তার মুখ ঘামে ভেজা, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে হাত তুলে ঢাক থামার ইশারা করল। পিনপতন নীরবতা।
"আত্মারা কথা বলেছেন!" বৃকাসের কণ্ঠস্বর যেন রাতের স্তব্ধতা চিরে দিল। "তারা মৃগাঙ্কর মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন তাদের অসন্তোষের কারণ!"
সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
"আমাদের এই শৈলপ্রস্থে অশুদ্ধতা প্রবেশ করেছে," বৃকাস বলতে লাগল, তার আঙুল অশুভ ইঙ্গিতের মতো ঘুরছে। "পূর্বপুরুষেরা বলছেন, যতক্ষণ না সেই অশুদ্ধি দূর হচ্ছে, ততক্ষণ অরণ্য আমাদের প্রতি সদয় হবে না, নদী মাছ দেবে না, মাটি ফসল ফলাবে না!"
"কী সেই অশুদ্ধতা, দলপতি?" ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল।
বৃকাস এবার ধীরে ধীরে চারুলতার দিকে ঘুরল। "আত্মারা বলছেন, পুরনো জ্ঞান সবসময় নতুন সময়ের জন্য যথেষ্ট নয়। তারা বলছেন, এমন কেউ আছে যে পুরনো প্রথা আঁকড়ে ধরে নতুন সত্যকে অস্বীকার করছে। তারা চাইছেন... পরিবর্তন।" তার দৃষ্টি চারুলতার মুখে স্থির।
চারুলতা চোখ তুলে তাকাল। তার দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু তাতে কোনো ভয় নেই। যেন সে জানত, এমন কিছুই হতে চলেছে।
"এবং," বৃকাস এবার তার স্বর আরও নামিয়ে আনল, যেন কোনো ভয়ঙ্কর গোপন কথা বলছে, "তারা চাইছেন উৎসর্গ। এমন উৎসর্গ যা প্রমাণ করবে আমরা শুদ্ধ হতে চাই, আমরা দেবতাদের ভয় করি।"
"কী উৎসর্গ?" প্রশ্নটা এবার যেন ভিড়ের সবার মুখ থেকে একসাথে বেরিয়ে এল।
বৃকাস কিছুক্ষণ চুপ রইল, যেন কথাটা বলার জন্য শক্তি সঞ্চয় করছে। তারপর বলল, "তারা চেয়েছেন... শৈলপ্রস্থের সবচেয়ে قیمتی (কিমতি - মূল্যবান, এখানে ফারসি বা অন্য বহিরাগত ভাষার শব্দ ব্যবহার করে বৃকাসের ক্ষমতা ও প্রভাব বোঝানো হচ্ছে) শিকার। তারা চেয়েছেন... একটি মানব উৎসর্গ!"
কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো শোনাল। ভিড়ের মধ্যে একটা চাপা আর্তনাদ উঠল। মানব বলি! এ প্রথা শৈলপ্রস্থে কখনও ছিল না। মানুষ ভয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কার পালা আসবে?
আর্য্যকের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মানব বলি! বৃকাস এতদূর যেতে পারে? এ তো শুধু ক্ষমতা নয়, এ উন্মাদনা! সে দেখল মৃগাঙ্ক তখনও ঘোরের মধ্যে ঢুলছে, সে হয়তো জানেও না তার মুখ দিয়ে কী ভয়ঙ্কর কথা বলানো হল।
"আত্মারা নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি," বৃকাস আবার বলতে শুরু করল, যেন সে নিজেই এই ভয়ঙ্কর দাবিতে কিছুটা বিচলিত, কিন্তু সে তো শুধু বার্তাবাহক। "তারা শুধু বলেছেন, সেই উৎসর্গ হতে হবে এমন একজনকে, যে নিজেই পবিত্র, যার রক্ত আমাদের মাটিকে শুদ্ধ করবে। তারা বলেছেন, পূর্ণিমার চাঁদ সাতবার ফিরে আসার আগে এই উৎসর্গ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে শামান মৃগাঙ্কই আমাদের জানাবেন, কে হবে সেই পবিত্র উৎসর্গ।"
কথাটা বলে বৃকাস মৃগাঙ্কর দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন ছেলেটাই সব ঠিক করবে। কিন্তু সবাই বুঝল, কে উৎসর্গ হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন কার হাতে চলে গেল। বৃকাস এই সাত মাস ধরে শৈলপ্রস্থের মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে পারবে। যাকে ইচ্ছা অশুদ্ধ বলতে পারবে, যাকে ইচ্ছা পবিত্র ঘোষণার ভয় দেখাতে পারবে।
আর্য্যক দেখল, মানুষজন ভয়ে কাঁপছে। কেউ কেউ মাটিতে বসে পড়েছে। তাদের এতদিনের চেনা পৃথিবীটা যেন এক মুহূর্তে ওলটপালট হয়ে গেল। যে বৃকাস ছিল তাদের রক্ষক, সে-ই এখন হয়ে উঠল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। আর এই আতঙ্কের মূলে রয়েছে ধর্মবিশ্বাস আর অসহায় মৃগাঙ্ক নামের এক কিশোর।
পুজো শেষ হল। কিন্তু কারো মনে শান্তি নেই। মানুষ যে যার কুটিরের দিকে পা বাড়াল। তাদের চলার পথে চাঁদের আলোয় দীর্ঘ ছায়া পড়ছে, যেন অশরীরী আত্মারা সত্যিই তাদের অনুসরণ করছে। আর্য্যক বুঝল, আজকের রাতটা শুধু শুরু। আসল খেলাটা এখনও বাকি। বৃকাস তার জাল ফেলেছে, এখন শুধু শিকার ধরার অপেক্ষা। আর সেই শিকার কে হবে? মৃগাঙ্ক? চারুলতা? নাকি অন্য কেউ? আর্য্যকের মনে হল, তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী? এই অন্ধ বিশ্বাস আর ভয়ের বিরুদ্ধে সে একা কী করতে পারে?
সে শেষবারের মতো নর্মদার দিকে তাকাল। নদীর জল আগের মতোই বয়ে চলেছে, উদাসীন, নির্বিকার। যেন মানুষের এই ভয়, লোভ আর ষড়যন্ত্রের খেলা তার কাছে কিছুই নয়। হাজার হাজার বছর ধরে সে এমন কত খেলা দেখেছে, আবার দেখবে। কিন্তু শৈলপ্রস্থের মানুষগুলোর কাছে এটাই এখন চরম বাস্তব। এক ভয়ঙ্কর বাস্তব।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাতের সেই ভয়ঙ্কর ঘোষণার পর কয়েকটা দিন যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে শৈলপ্রস্থের বুকের ওপর চেপে বসল। পূর্ণিমার গোল চাঁদটা একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে লাগল, কিন্তু মানুষের মনের ভয় কমল না, বরং বাড়ল। শিকার আগের মতোই অমিল, নর্মদার জালে মাছ পড়ছে না বললেই চলে। প্রতিটা ব্যর্থ দিন যেন বৃকাসের ঘোষিত অভিশাপকেই সত্যি বলে প্রমাণ করছিল। মানুষজন আগের চেয়েও বেশি চুপচাপ হয়ে গেল। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বিশেষ কথা বলে না, প্রতিবেশীর দিকেও তাকায় সন্দেহের চোখে— কে জানে, কার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই ‘অশুদ্ধতা’ যার জন্য সকলের এই ভোগান্তি!
মৃগাঙ্কর কুটিরের সামনে এখন সবসময় দুজন প্রহরী থাকে বৃকাসের নির্দেশে। ছেলেটা এখন আর আগের মতো একা একা নদীর ধারে ঘুরতে যায় না। সে এখন ‘শামান’, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মাঝে বৃকাস তাকে ডেকে পাঠায়, তারপর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এসে হয়তো জানায়, শামান আজ ধ্যানে বসবেন বা আত্মাদের সাথে কথা বলবেন। গ্রামের লোক দূর থেকে মৃগাঙ্কর কুটিরটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাছে ঘেঁষে না। ছেলেটার চোখের সেই শূন্য দৃষ্টি, সেই মাঝে মাঝে শরীর বেঁকিয়ে অদ্ভুত আচরণ করা— যা আগে ছিল করুণা বা বিরক্তির বিষয়, এখন তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয় মেশানো শ্রদ্ধার বস্তু। মানুষ কতটা অসহায় হলে অসুস্থতাকেও দেবত্ব বলে মেনে নেয়! আর্য্যক ভাবে আর অবাক হয়।
চারুলতার অবস্থা হয়েছে আরও করুণ। যে বৃদ্ধার কাছে একদিন সবাই ছুটে আসত সামান্য জ্বর বা পেটের ব্যথায় একমুঠো শেকড়বাকড়ের জন্য, যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত আসন্ন বর্ষার খবর জানতে, তাকে এখন বেশিরভাগ মানুষই এড়িয়ে চলে। বৃকাস সরাসরি তার নাম না করলেও, ‘পুরনো জ্ঞান আঁকড়ে ধরে নতুন সত্যকে অস্বীকার করা’র ইঙ্গিতটা সবাই বুঝেছে। কেউ কেউ আড়ালে বলতে শুরু করেছে, চারুলতাই হয়তো সেই ‘অশুদ্ধতা’র মূল। বৃদ্ধা অবশ্য আগের মতোই শান্ত, নিজের কুটিরের সামনে বসে চুপচাপ চরকায় সুতো কাটে বা শুকনো পাতা জড়ো করে। কিন্তু তার চোখের কোণে জমে থাকা ক্লান্তিটা আর্য্যকের নজর এড়ায় না।
আর্য্যক ঠিক করল, তাকে কিছু একটা করতেই হবে। শুধু সন্দেহ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সে সুযোগ খুঁজতে লাগল মৃগাঙ্কর সাথে একা কথা বলার। কিন্তু বৃকাসের প্রহরীদের এড়িয়ে সেটা প্রায় অসম্ভব। ছেলেটাকে এখন এমনভাবে আগলে রাখা হয়েছে, যেন সে মানুষ নয়, কোনো قیمتی বস্তু।
একদিন দুপুরে আর্য্যক ইচ্ছা করেই মৃগাঙ্কর কুটিরের কাছাকাছি একটা বড় গাছের তলায় বসে তার ধনুকের ছিলা সারাতে লাগল। প্রহরী দুজন ছায়ায় বসে ঝিমোচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর মৃগাঙ্ক কুটিরের দরজায় এসে দাঁড়াল। রোদে তার মুখটা আরও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। আর্য্যকের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। এই সুযোগ!
সে ধীরে ধীরে উঠে মৃগাঙ্কর দিকে এগিয়ে গেল। প্রহরী দুজন নড়েচড়ে উঠল, কিন্তু আর্য্যককে তারা চেনে, তাই বিশেষ বাধা দিল না।
"কেমন আছিস, মৃগাঙ্ক?" আর্য্যক 최대한 সহজ গলায় ডাকল।
মৃগাঙ্ক চমকে তাকাল। তার চোখে পরিচিতির আলো নেই, শুধু ভয় আর বিভ্রান্তি। সে কিছু না বলে কুটিরের ভেতর ঢুকে যেতে চাইল।
"একটু দাঁড়া," আর্য্যক তার হাতটা আলতো করে ধরল। "তোর কি শরীরটা এখনও খুব খারাপ লাগছে?"
মৃগাঙ্ক হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না, কিন্তু তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে ফিসফিস করে বলল, "আমার কাছে এসো না, আর্য্যক। আমার ভেতর আত্মারা থাকেন। তারা রুষ্ট হতে পারেন।"
"আত্মারা?" আর্য্যক ছেলেটার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। "নাকি বৃকাস তোকে এসব বলতে শিখিয়েছে?"
মৃগাঙ্কর চোখ দুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেল। সে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। "আমি কিছু জানি না... আমি কিছু বুঝি না... বৃকাস যা বলে, আমি তাই করি... আমার খুব ভয় করে, আর্য্যক..."
আর কিছু বলার সুযোগ হল না। প্রহরী দুজন এগিয়ে এসে আর্য্যককে প্রায় ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দিল। "শামানের সাথে কথা বলা নিষেধ। দলপতির হুকুম।"
আর্য্যক সরে এল, কিন্তু তার মনটা আরও দৃঢ় হল। মৃগাঙ্ক স্পষ্টতই ভয় পেয়েছে এবং তাকে যা শেখানো হচ্ছে, তাই বলছে। সে কোনো শামান নয়, সে বৃকাসের হাতের পুতুল। কিন্তু এই সত্যিটা সে প্রমাণ করবে কী করে?
সেদিন সন্ধ্যায় আর্য্যক গেল চারুলতার কুটিরে। বৃদ্ধা তখন আগুনের আঁচে মাটির হাঁড়িতে কী যেন জ্বাল দিচ্ছিল। ধোঁয়ায় ঘরটা অন্ধকার।
"ভেতরে আসতে পারি, দিদা?" আর্য্যক বাইরে থেকে ডাকল। (শৈলপ্রস্থে সবাই চারুলতাকে 'দিদা' বলেই ডাকত)।
চারুলতা মুখ না ঘুরিয়েই বলল, "আয়। এখনো যে কেউ আমার কুটিরের পথ ভুলে যায়নি, সেটাই আশ্চর্য।" তার গলায় অভিমান না ক্লান্তি, বোঝা গেল না।
আর্য্যক ভেতরে ঢুকে তার পাশে বসল। "আপনার কি মনে হয়, দিদা? মৃগাঙ্কর কি সত্যিই কোনো ক্ষমতা আছে?"
চারুলতা কিছুক্ষণ চুপচাপ আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "قدرت (কুদরত - ক্ষমতা) দু'রকমের হয়, বাছা। এক হল প্রকৃতির দান, যা আসে নিজের ভেতর থেকে, সাধনা থেকে। আরেক হল কেড়ে নেওয়া ক্ষমতা, যা আসে ভয় দেখিয়ে, ছলনা করে। মৃগাঙ্কর ক্ষমতা দ্বিতীয় দলের।"
"তাহলে আপনি বৃকাসকে বাধা দিচ্ছেন না কেন?"
"কী করে দেব?" চারুলতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "লোকে এখন ভয়কেই ভগবান মানে। আমি যদি মুখ খুলি, বৃকাস কালই ঘোষণা দেবে, আমিই সেই অশুদ্ধ নারী, আমাকেই বলি দিতে হবে। তুই কি চাস সেটা?"
আর্য্যক চমকে উঠল। সে বুঝতে পারল চারুলতার অসহায়তা। কিন্তু সে сдаваться (স্দাভাতসা - হাল ছেড়ে দেওয়া, এখানে যেন এক স্লাভিক বা মধ্য এশীয় যাযাবর গোষ্ঠীর ভাষার শব্দ ব্যবহার করে আর্য্যকের মনের দৃঢ়তা বোঝানো হচ্ছে) পাত্র নয়। "কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। মানব বলি! এ অন্যায়।"
"অন্যায় তো বটেই," চারুলতা তার দিকে ফিরল। তার চোখে আগুনের আভা। "কিন্তু বৃকাসকে থামাতে হলে শুধু মুখের কথায় হবে না। প্রমাণ চাই। এমন প্রমাণ যা সবার চোখ খুলে দেবে।"
"কী প্রমাণ?"
"আমি দেখেছি, বৃকাস মৃগাঙ্ককে মাঝে মাঝে কীসের যেন রস খাওয়ায়। ছেলেটা তারপরই কেমন নেতিয়ে পড়ে, বিড়বিড় করতে থাকে। ওই জিনিসটা খুঁজে বের করতে পারবি? ওটা হয়তো এমন কোনো গাছের রস যা মতিভ্রম ঘটায়।"
আর্য্যকের মনে পড়ল, তাদের গ্রামের পাশে এক ধরনের বুনো ধুতুরা জাতীয় গাছ জন্মায়, যার ফল খেলে মানুষ কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, যা তা বকে। চারুলতা কি সেটার কথাই বলছে?
"আমি চেষ্টা করব, দিদা।" আর্য্যক উঠে দাঁড়াল। তার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। যদি সে প্রমাণ করতে পারে যে মৃগাঙ্কর 'দৈব ক্ষমতা' আসলে বৃকাসের দেওয়া বিষাক্ত ফলের রসায়নের খেলা, তাহলে হয়তো মানুষ বৃকাসের আসল চেহারাটা চিনতে পারবে।
"সাবধানে থাকিস, আর্য্যক," চারুলতা সতর্ক করল। "বৃকাসের চোখ এখন সবার ওপর। বিশেষ করে তোর ওপর।"
কুটির থেকে বেরিয়ে আসার সময় আর্য্যকের মনে হল, লড়াইটা কেবল শুরু হল। একদিকে বৃকাসের তৈরি করা ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের জাল, অন্যদিকে সত্যিটা খুঁজে বের করার কঠিন প্রতিজ্ঞা। মাঝখানে অসহায় মৃগাঙ্ক আর প্রজ্ঞাবতী কিন্তু কোণঠাসা চারুলতা। আর সময়? মাত্র সাতটা পূর্ণিমা। তার আগেই তাকে বৃকাসের মুখোশটা খুলে দিতে হবে, নইলে শৈলপ্রস্থের মাটি সত্যিই একদিন নিরপরাধের রক্তে ভিজে উঠবে।
চাঁদটা আরও একটু ক্ষয়ে গেছে। নর্মদার তীরে রাতচরা পাখির ডাক কেমন যেন অশুভ শোনাচ্ছে। আর্য্যক তার কুটিরের দিকে পা বাড়াল, তার মস্তিষ্কে তখন একটাই চিন্তা— কীভাবে বৃকাসের কুটিরের আশেপাশে ওই সন্দেহজনক গাছের সন্ধান পাওয়া যায়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সময় গড়িয়ে চলে তার নিজের নিয়মে, কিন্তু শৈলপ্রস্থের বুকে সময় যেন থমকে গেছে সেই অভিশপ্ত পূর্ণিমার রাতে। আরও একটা চাঁদ প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গিয়ে আবার নতুন করে আকাশে উঁকি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। শিকার এখনও অমিল, নদীর ধার থেকে জেলেরা ফেরে প্রায় শূন্য হাতে। কুটিরগুলোতে রাতের অন্ধকারে শোনা যায় চাপা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস। মজুত করা যবের দানা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অভুক্ত শিশুদের কান্না রাতের নীরবতাকে আরও অসহনীয় করে তোলে। এই ক্রমবর্ধমান হতাশা বৃকাসের হাতকেই শক্ত করছিল। মানুষ এখন যেকোনো মূল্যে মুক্তি চায়, এমনকি যদি তার জন্য কাউকে বলিও দিতে হয়!
আর্য্যক এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছিল আর তার ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছিল। চারুলতার কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল— প্রমাণ চাই। সে ঠিক করল, আর অপেক্ষা করা যায় না। তাকে বৃকাসের আশেপাশে ওই সন্দেহজনক উদ্ভিদের সন্ধান করতেই হবে।
পরিকল্পনাটা সহজ ছিল না। বৃকাসের কুটিরটা বসতির একেবারে কেন্দ্রে, আর তার আশেপাশে সবসময় দলপতির অনুগত কিছু লোক ঘুরঘুর করে। দিনের আলোয় সেখানে কিছু খোঁজা মানে আত্মহত্যার সামিল। আর্য্যককে অপেক্ষা করতে হল রাতের অন্ধকারের জন্য, অথবা ভোরের সেই আবছা আলো-আঁধারির জন্য যখন পৃথিবী পুরোপুরি জেগে ওঠে না।
কয়েকটা রাত সে বৃকাসের কুটিরের আশেপাশে ঘুরে কাটাল। শুকনো পাতার ওপর পা ফেলে নিঃশব্দে হাঁটার কৌশল তার জানা। গাছের ছায়া, পাথরের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে সে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। বৃকাস কখন ঘুমোয়, কখন বেরোয়, তার আবর্জনা কোথায় ফেলা হয়। কাজটা ছিল বিপজ্জনক। একবার প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল সে। বৃকাসের কুটিরের পেছন দিকে সে যখন উঁকিঝুঁকি মারছে, হঠাৎ ভেতর থেকে কাশির শব্দ এল। আর্য্যক নিমেষে পাশের এক ঝোপের মধ্যে মিশে গেল। বৃকাস বেরিয়ে এসে বাইরেটা দেখে নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল। আর্য্যকের হৃদপিণ্ড তখন ঢাকের মতো বাজছে।
কয়েক দিন ব্যর্থ চেষ্টার পর আর্য্যকের মনে হল, কুটিরের আশেপাশে নয়, বৃকাস নিশ্চয়ই জিনিসটা আনে অন্য কোথা থেকে। সে এবার বৃকাসের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করল। দলপতি হিসেবে তাকে সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়— শিকারিদের দল পাঠানো, কুটির মেরামত তদারক করা, বিবাদ মেটানো। কিন্তু আর্য্যক লক্ষ্য করল, বৃকাস প্রায় প্রতি দু-তিন দিন অন্তর বিকেলের দিকে একা একা নদীর উজানের দিকে জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ভেতরে চলে যায়। বেশিক্ষণ থাকে না, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসে। কিন্তু ওই সময়টায় সে কোথায় যায়, কেন যায়?
একদিন বিকেলে বৃকাস আবার সেদিকে রওনা দিতেই আর্য্যক কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করল। কাজটা কঠিন, কারণ বৃকাস নিজেও একজন தேர்ந்த শিকারি, তার অনুভূতি প্রখর। আর্য্যককে খুব সাবধানে গাছের আড়াল থেকে আড়ালে সরে যেতে হচ্ছিল।
নদীর ধার ঘেঁষে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বৃকাস একটা ছোট টিলার মতো জায়গায় উঠল, যেখানে ঝোপঝাড় বেশ ঘন। সেখানে ঢুকে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর্য্যক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর অত্যন্ত সন্তর্পণে সেও টিলাটার দিকে এগিয়ে গেল। ঝোপের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে আর অন্ধকার। নানা রকম বুনো লতাপাতা আর কাঁটাগাছে ভর্তি। একটু এগোতেই আর্য্যক দেখল, এক জায়গায় ঝোপটা একটু পরিষ্কার, যেন কেউ নিয়মিত যাতায়াত করে। আর সেখানেই, মাটির ওপর পড়ে আছে কয়েকটা থেঁতলানো ফল আর পাতা।
আর্য্যক ঝুঁকে পড়ে জিনিসগুলো তুলে নিল। ফলগুলো ছোট, গোল, গায়ে হালকা কাঁটা। পাতাগুলো দেখতে অনেকটা পরিচিত লাগল তার। সে সাবধানে কয়েকটা ফল আর পাতা নিজের কোমরের চামড়ার থলিতে ভরে নিল। এটা কি সেই বুনো ধুতুরা যা মতিভ্রম ঘটায়? চারুলতা হয়তো সঠিকভাবে বলতে পারবে।
সে যখন ফিরতে উদ্যত, তখনই তার কানে এল একটু দূরে পায়ের শব্দ। বৃকাস ফিরছে! আর্য্যক بسرعة একদিকের ঘন ঝোপের মধ্যে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দিল। বৃকাস জায়গাটা পেরিয়ে চলে গেল নদীর দিকে, তার মুখে একটা চাপা সন্তুষ্টির ভাব। সে বোধহয় তার প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে ফিরে যাচ্ছে।
আর্য্যক অপেক্ষা করল বৃকাস বেশ কিছুটা দূরে চলে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর সেও দ্রুত পায়ে বসতির দিকে রওনা দিল। তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনা আর আশঙ্কায় কাঁপছে। সে একটা সূত্র পেয়েছে! কিন্তু জানে কি বৃকাস যে তাকে কেউ অনুসরণ করেছিল?
বসতিতে ফিরে আসার পথে তার দেখা হল ইরাবতীর সাথে। ইরাবতী জল আনতে নদীর দিকে যাচ্ছিল। মেয়েটির মুখে হাসি নেই, চোখে কৌতূহল আর উদ্বেগ। "আজকাল তোমাকে দেখাই যায় না, আর্য্যক। এত কোথায় থাকো?" ইরাবতীর কণ্ঠে সহজ সরল জিজ্ঞাসা। "কাজ থাকে," আর্য্যক সংক্ষিপ্ত জবাব দিল। ইরাবতীর মতো মেয়েদের এই জটিল ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখাই ভালো। "শিকার কেমন চলছে?" "না, ভালো না," আর্য্যক অন্যমনস্কভাবে বলল। "সবাই বলছে, বলি না দিলে কিছুই ঠিক হবে না," ইরাবতীর গলায় ভয়। "সত্যিই কি তাই, আর্য্যক?" আর্য্যক মেয়েটির চোখের দিকে তাকাল। এই সরল বিশ্বাস, এই ভয়— এটাই বৃকাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সে কী করে বোঝাবে ইরাবতীকে যে পুরো ব্যাপারটাই একটা সাজানো নাটক? "জানি না," আর্য্যক শুধু এইটুকুই বলতে পারল। "তবে ভয় পেয়ো না।" সে দ্রুত পায়ে চারুলতার কুটিরের দিকে হাঁটা দিল।
চারুলতা তখন তার সামান্য রাতের খাবার তৈরি করছিল। আর্য্যককে দেখে এবং তার থলি থেকে বার করা ফল আর পাতাগুলো দেখে বৃদ্ধার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে পাতাগুলো হাতে নিয়ে শুঁকল, ফলগুলো টিপে দেখল। "হ্যাঁ," সে প্রায় ফিসফিস করে বলল। "এ তো সেই সর্বনেশে ফল! এর রস অল্প মাত্রায় খাওয়ালে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যা তা বকতে থাকে, চোখেও ভুল দেখে। বেশি খেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বৃকাস তাহলে এই জিনিসই ব্যবহার করছে মৃগাঙ্কর ওপর!"
প্রমাণ মিলেছে! অন্তত চারুলতা এবং আর্য্যকের কাছে। কিন্তু এটা গ্রামের লোককে বোঝানো যাবে কী করে? বৃকাস কি স্বীকার করবে?
ঠিক তখনই বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। বৃকাসের গলা। সে যেন কাউকে ধমকাচ্ছে। আর্য্যক আর চারুলতা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, বৃকাস রাগে গরগর করতে করতে এদিকেই আসছে, তার পেছনে দুজন অনুচর। আর্য্যকের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। বৃকাস কি জেনে গেছে? সে কি তাকে অনুসরণ করার ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে?
"আর্য্যক এখানে?" বৃকাস কুটিরের বাইরে থেকেই গর্জন করে উঠল। তার চোখ দুটো জ্বলছে।
আর্য্যকের মনে হল, পালানোর আর কোনো পথ নেই। সে চারুলতার দিকে একবার তাকাল। বৃদ্ধার মুখে ভয় নেই, আছে এক কঠিন সংকল্প। আর্য্যকও মন শক্ত করল। যা হওয়ার হবে। সে বেরিয়ে এল কুটিরের বাইরে, বৃকাসের মুখোমুখি দাঁড়াল। সময় যেন আবার থমকে দাঁড়াল নর্মদার তীরে। একদিকে কাঁচা ক্ষমতার ঔদ্ধত্য, অন্যদিকে সত্য খুঁজে পাওয়া এক যুবকের নির্ভীক দৃষ্টি। বাতাস বারুদের মতো ভারী হয়ে উঠল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বৃকাসের গলার স্বর রাতের স্তব্ধতাকে চিড়ে দিল, যেন দূর পাহাড়ে বাজ পড়ল। "আর্য্যক এখানে?" তার স্বর রাগে কাঁপছে।
আর্য্যক চারুলতার কুটিরের বাইরে এসে দাঁড়াল। তার হাতে ধরা চামড়ার থলিটা, যার ভেতরে রয়েছে সেই সর্বনেশে ফল আর পাতা। বৃকাসের পেছনে তার দুজন অনুচর, হাতে বাঁশের শক্ত লাঠি। চাঁদের আলোয় তাদের মুখগুলো কঠিন দেখাচ্ছে। বসতির অন্য কুটিরগুলো থেকেও হয়তো কেউ কেউ কৌতূহল আর ভয় মেশানো চোখে তাকাচ্ছে, কিন্তু কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না।
"হ্যাঁ, দলপতি," আর্য্যক শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় উত্তর দিল। সে জানে, এই মুহূর্তটা এড়ানোর কোনো উপায় নেই। লড়াইটা এখন মুখোমুখি।
বৃকাস আর্য্যকের সামনে এসে দাঁড়াল। তার তীক্ষ্ণ চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। "তুই আমার পেছনে লেগেছিস, আর্য্যক? তুই শামানের কথায় সন্দেহ করছিস?" তার কণ্ঠস্বর চাপা, কিন্তু ভয়ঙ্কর। "অরণ্যের আত্মা আর পূর্বপুরুষদের অভিসম্পাত ডেকে আনতে চাইছিস তুই?"
আর্য্যকের মনে হল, বৃকাস বিষয়টিকে ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং ধর্মীয় অবমাননা— দু’ভাবেই চিত্রিত করতে চাইছে। এটাই তার চাল। মানুষকে নিজের পক্ষে রাখার জন্য ভয় দেখানো।
"আমি সত্যকে জানতে চেয়েছি, দলপতি," আর্য্যক বলল। তার হাতে ধরা থলিটা একটু ওপরে তুলে ধরল সে। "আমি জানতে চেয়েছি, কেন মৃগাঙ্ককে শামান বলা হচ্ছে, যখন তার অসুস্থতা..."
"চুপ কর!" বৃকাস গর্জন করে উঠল। "তুই কী বলছিস তার কোনো মানে হয় না। তুই আমাদের বিশ্বাসকে আঘাত করছিস। তুই সেই অশুদ্ধতা, যার কথা আত্মা বলেছেন!"
কথাটা বৃকাস হয়তো আরও পরে ঘোষণা করার জন্য রেখেছিল, কিন্তু আর্য্যকের এই প্রকাশ্য প্রতিবাদ তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। ভিড়ের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। আর্য্যক! সেই অশুদ্ধতা!
"মিথ্যে কথা!" চারুলতা হঠাৎ কুটিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। তার শীর্ণ শরীরটা যেন ঘৃণায় শক্ত হয়ে উঠেছে। "এ ছেলে কোনো অশুদ্ধতা নয়। অশুদ্ধি তো তোমার মনে, বৃকাস! তুমি তোমার ক্ষমতার জন্য একটা অসুস্থ ছেলেকে আর ভয় পাওয়া মানুষদের ব্যবহার করছ!"
বৃকাস চারুলতার দিকে ঘুরল। তার মুখে এবার ভয় মেশানো ক্রোধ। বৃদ্ধা এতদিন চুপচাপ ছিল, সে ভাবেনি চারুলতা এইভাবে প্রতিবাদ করবে। "বুড়ি! তুই মুখ খুলছিস? তুই-ই সেই পুরনো আঁকড়ে থাকা জরা! তোকে..."
"আমি জরা নই, বৃকাস," চারুলতা বৃকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। তার গলায় কোনো জড়তা নেই। "আমি শৈলপ্রস্থের জ্ঞান, তার স্মৃতি। আর আমি জানি, এই ফলগুলোর রস খাইয়ে তুমি মৃগাঙ্ককে দিয়ে যা বলাচ্ছ, তা কোনো আত্মাদের কথা নয়, তা তোমার নিজের কথা! এই দেখ!"
চারুলতা আর্য্যকের হাত থেকে থলিটা নিয়ে ভেতর থেকে ফলগুলো বার করে ভিড়ের দিকে দেখাল। "এই ফল! এর রস মানুষকে আচ্ছন্ন করে তোলে, যা তা বকায়! বৃকাস মৃগাঙ্ককে দিয়ে এই বিষাক্ত ফল খাওয়ায়, আর তারপর বলে পূর্বপুরুষের আত্মা কথা বলছে! এ অধর্ম! এ মিথ্যা!"
ভিড়ের মধ্যে এবার স্পষ্ট গুঞ্জন উঠল। ফলগুলো এখানকার লোক চেনে। কেউ কেউ হয়তো জানত, বেশি খেলে কী হয়। কিন্তু এর রস যে এইভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা তারা ভাবেনি। তাদের মনে সংশয় দেখা দিতে লাগল। ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের দেওয়ালে চিড় ধরতে শুরু করেছে।
বৃকাসের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তার চাল ধরা পড়ে গেছে। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল, চারুলতাকে এতদিন কোণঠাসা করে রাখাটা তার ভুল হয়েছিল। তার জ্ঞান আর বিশ্বাস গ্রামের গভীরে শিকড় গেড়ে আছে। আর্য্যক এবং চারুলতা দুজন মিলে তার ক্ষমতার ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে।
সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। তার চোখে ফুটে উঠল এক ভয়ঙ্কর সঙ্কল্প। প্রমাণ! প্রমাণ মানে না মূর্খ মানুষেরা। তারা মানে শক্তি আর ঘোষণা।
"এ বুড়ি মিথ্যা বলছে!" বৃকাস গলা চড়াল। "এ আমাকে হেয় করতে চাইছে! এই ফল পবিত্র! আত্মা নির্দেশ দিয়েছেন, এই ফল শামানকে শক্তি দেবে! আর এই আর্য্যক," সে আর্য্যকের দিকে আঙুল তাক করল, "এ শয়তানের প্রভাবে পড়েছে! এ আমাদের সবাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইছে!"
তারপর তার অনুচরদের দিকে ফিরে আদেশ দিল, "ধর এদের! আর্য্যক আর এই বুড়ি— এরাই সেই অশুদ্ধতা! এরাই আত্মা এবং পূর্বপুরুষদের রুষ্ট করেছে। এদের বন্দী করো! পূর্ণিমার আগেই হয়তো এদের রক্তেই শুদ্ধ হবে আমাদের মাটি!"
অনুচর দুজন আর্য্যক আর চারুলতার দিকে এগিয়ে এল। ভিড়ের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। ভয় আর সংশয়ের মধ্যে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বৃকাসের কথা কি ঠিক? নাকি চারুলতা আর আর্য্যক সত্য বলছে? দ্বিধা আর আতঙ্ক তাদের paralyze করে রেখেছে।
আর্য্যক বুঝল, কথা বলার সময় শেষ। নিজেকে বাঁচাতে হবে। সে দ্রুত হাতে নিজের ধনুকটা তুলে নিল, যা তার পাশে রাখা ছিল। অনুচর দুজন কাছাকাছি আসতেই সে ধনুকের ছিলা টানতে উদ্যত হল। কিন্তু তার আগে বৃকাস হাঁক দিল, "সাবধান, আর্য্যক! রক্তপাত ঘটালে তোর পাপ আরও বাড়বে! তুই কি আমাদেরই মারতে চাস?"
আর্য্যকের হাতটা থেমে গেল। না, সে নিজের লোকেদের ওপর অস্ত্র তুলতে পারবে না। সে শুধু আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হল।
চারুলতা স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখে কোনো ভয় নেই, শুধু এক গভীর, ক্লান্ত দৃষ্টি। সে যেন অনেক আগেই নিজের ভবিতব্য জেনে গেছে।
অনুচর দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই বৃকাস হঠাৎ চারুলতার দিকে তাকাল, যেন নতুন কোনো কৌশল তার মাথায় এসেছে। "না," বৃকাস বলল, তার গলায় এক নতুন সুর— ভয় মেশানো সতর্কতা। "এদের এখনই মারা যাবে না। আত্মা হয়তো এদেরই উৎসর্গ চাইছেন! আর্য্যক, তুই আমাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিস। তোকে প্রমাণ করতে হবে তুই নির্দোষ। চারুলতা, তোর জ্ঞান মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন আত্মা বিচার করবেন।"
বৃকাস তার অনুচরদের বলল, "আর্য্যক আর এই বুড়িকে বন্দী করো। এদের কুটিরে আলাদা করে রাখো। আর মৃগাঙ্ক! শামানকে আরও কড়া পাহারায় রাখো! কেউ যেন তার কাছে ঘেঁষতে না পারে!"
আর্য্যক প্রতিরোধ করতে পারত, কিন্তু চারুলতাকে বিপদে ফেলতে চাইল না। অনুচর দুজন এসে তার হাত ধরল। চারুলতা কোনো বাধা দিল না। তাদের ধরে আলাদা আলাদা কুটিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো।
চারুলতার কুটিরের বাইরে থলিটা পড়ে রইল। ভেতর থেকে ফলগুলো গড়িয়ে অন্ধকার মাটিতে মিশে গেল। প্রমাণটা এখন পড়ে রইল অবহেলায়, বৃকাসের ক্ষমতার জালের সামনে তা অকিঞ্চিৎকর।
আর্য্যককে তার নিজের কুটিরেই বন্দী করা হল। বাইরে দুজন অনুচর পাহারায়। অন্ধকারের মধ্যে সে শুনতে পাচ্ছে নর্মদার জলের কুলকুল শব্দ। সেই শব্দ এখন আর মায়ের মতো মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন কোনো ভয়ঙ্কর শিকারি নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। সে বন্দী। চারুলতা বন্দী। মৃগাঙ্ক বৃকাসের হাতে পুতুল। আর গ্রামের মানুষ? তারা ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের জালে আবদ্ধ।
আর্য্যকের মনে হল, শৈলপ্রস্থের আকাশে রক্তরাঙা চাঁদ উঠতে আর বেশি দেরি নেই। আর সেই রক্ত হয়তো হবে তাদেরই, যারা সত্যকে সামনে আনতে চেয়েছিল। তার হাতে ধরা ধনুকটা শক্ত করল সে। যেকোনো মূল্যে তাকে পালাতে হবে। চারুলতাকে বাঁচাতে হবে, আর হয়তো মৃগাঙ্ককেও। কিন্তু কীভাবে? বাইরে পাহারায় বসে থাকা লোকগুলো নিছক অনুচর নয়, বৃকাসের ক্ষমতার প্রতীক। তাদের পেরিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। আর সময়ও হাতে বেশি নেই। সাত পূর্ণিমার চক্র শুরু হয়ে গেছে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ভেতরটা জমাট বাঁধা অন্ধকারে ডুবে আছে। আর্য্যকের মনে হল, তার চারপাশের বেড়াগুলো যেন শুধু মাটি আর ডালপালা দিয়ে তৈরি নয়, সেগুলো আসলে ভয় আর অসহায়ত্বের প্রতীক। বাইরে দুজন অনুচর পাহারায়। তাদের পায়ের শব্দ, মাঝে মাঝে কাশির আওয়াজ— সবই আর্য্যকের কানে পৌঁছাচ্ছে। প্রতিটা শব্দ যেন উপহাস করছে তাকে। সে চেষ্টা করেছিল, সত্যকে সামনে আনতে চেয়েছিল, আর তার ফল হয়েছে এই বন্দী দশা।
কপালে হাত দিয়ে আর্য্যক বসে পড়ল। চারুলতা দিদা! বৃদ্ধা এই বয়সে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তার সমস্ত জ্ঞান আর সম্মানকে বাজি রেখেছিল। আর এখন সেও বন্দী। বৃকাস ওদের দুজনকে আলাদা করে রেখেছে। সম্ভবত চারুলতা দিদার ওপর নির্যাতন করবে সে, নয়তো ভয় দেখিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করবে। আর মৃগাঙ্ক? সেই ছেলেটা এখন কেমন আছে কে জানে। বৃকাসের হাতে পড়ে তার জীবনটা হয়তো আরও বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
আর্য্যকের বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। বৃকাস! কী ভয়ঙ্কর তার লোভ আর ক্ষমতা লিপ্সা। মানুষকে পশুদের চেয়েও নিচে নামিয়ে এনেছে সে শুধু নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য। ধর্ম আর বিশ্বাসকে কী সহজেই সে হাতিয়ার করে তুলেছে। আর শৈলপ্রস্থের এই নিরীহ মানুষগুলো! তারা ভয় পায়, তাই বিশ্বাস করে। না খেয়ে থাকার ভয়, অসুস্থতার ভয়, সবচেয়ে বড় কথা— অদৃশ্য কোনো শক্তির রুষ্ট হওয়ার ভয়। এই ভয়ই বৃকাসের শক্তি।
কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। তাকে বেরোতেই হবে। চারুলতা দিদাকে বাঁচাতে হবে। মৃগাঙ্ককে হয়তো বাঁচানো সম্ভব নয়, অন্তত এখনই নয়। কিন্তু চারুলতা... তিনি এই গ্রামের শেকড়। তার জ্ঞান আর সাহস বৃকাসের মিথ্যের মুখোশ খুলে দিতে পারত।
আর্য্যক উঠে দাঁড়াল। কুটিরটা সামান্যই মজবুত। গাছের মোটা ডাল পুঁতে তার ওপর আড়াআড়িভাবে সরু ডালপালা আর কাদা দিয়ে তৈরি। দরজাটা ভেতর থেকে শেকল দিয়ে আটকানো, কিন্তু বাইরে পাহারাদার আছে। আর্য্যক চারপাশের বেড়া পরীক্ষা করতে লাগল। মাটি শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ডালপালাগুলো শক্ত। কিন্তু এই রকম কুটির তৈরি করার সময় সবসময় একটা দুর্বল দিক থেকে যায়।
বহু বছর ধরে শিকার আর বনের গভীরে ঘোরাফেরা করার ফলে আর্য্যকের শরীর লোহার মতো শক্ত আর নমনীয়। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অন্ধকারের মধ্যেও সে খুঁটিনাটি দেখতে পায়। সে কুটিরটার পেছন দিকে গেল। দিনের আলোয় সে হয়তো এখানে কিছু পেত না, কিন্তু রাতে, অন্ধকারে, পাহারাদারদের অসতর্ক মুহূর্তে কিছু সুযোগ তৈরি হতে পারে।
সে নিচু হয়ে বেড়ার নিচের অংশটা পরীক্ষা করতে লাগল। মাটি আর ডালপালার ফাঁক গলে আসা ঠান্ডা বাতাস তার মুখে লাগছে। হঠাৎ তার হাতে একটা আলগা ডাল ঠেকল। জায়গাটা বাকি অংশের চেয়ে সামান্য নরম মনে হলো। বর্ষার সময় হয়তো এখানেই জল জমে ছিল, তাই মাটিটা ঠিকমতো শক্ত হয়নি।
আর্য্যক তার কোমরের চামড়ার থলিতে হাত ঢোকাল। ভেতর থেকে তার প্রিয় hunting knife বার করল। বুনো পশুর হাড় ঘষে তৈরি ধারালো ছুরি। সে আলগা ডালটার চারপাশে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। কাজটি করতে হচ্ছে অত্যন্ত সতর্কভাবে, যাতে বাইরে পাহারাদাররা বিন্দুমাত্র শব্দ শুনতে না পায়। শ্বাস বন্ধ করে সে কাজ করছে। হাতের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সাবধানে সে মাটি সরাচ্ছে। আলগা ডালটা এবার পুরোটা নড়ছে। তার পাশে আরও দু-তিনটে ডাল মনে হচ্ছে আলগা হয়ে গেছে। মাটির ভেতর দিকটা খুঁড়তে খুঁড়তে তার আঙুল পাথরের মতো কিছু একটা স্পর্শ করল। এটা কি সেই ফলগুলো? চারুলতা দিদার থলি থেকে পড়ে যাওয়া ফল? হ্যাঁ, অন্ধকারেও সে ফলগুলোর গাঢ় গন্ধ চিনতে পারল। সে একটা ফল তুলে নিল হাতে। প্রমাণটা এখানেই পড়ে ছিল!
কিন্তু এখন প্রমাণ নিয়ে কী করবে? বন্দী অবস্থায় প্রমাণ দেখিয়ে লাভ নেই। আগে পালাতে হবে।
সে মাটি খোঁড়া চালিয়ে গেল। অনেকটা মাটি সরানোর পর বেড়ার নিচের দিকে একটা গর্ত তৈরি হলো। গর্তটা খুব বড় নয়, কিন্তু আর্য্যকের মতো ছিপছিপে শরীরের লোকের জন্য Crawling out (হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসা) সম্ভব। সমস্যা হলো, এটা করতে গেলে সামান্য হলেও শব্দ হবে।
আর্য্যক কিছুক্ষণ থামল। কান পেতে শুনল বাইরের শব্দ। পাহারাদার দুজন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। তাদের মনোযোগ এখন হয়তো অন্য দিকে। এই সুযোগ!
সে হাতে ছুরিটা নিয়ে গর্তের মুখে শুয়ে পড়ল। শরীরটাকে 최대한 ছোট করে সে গর্তের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিতে শুরু করল। প্রথমে মাথা, তারপর কাঁধ। শুকনো মাটি আর ডালপালা তার গায়ে মুখে লাগছে। একটা তীক্ষ্ণ ডাল তার হাতে আঁচড় কাটল, সামান্য রক্ত বেরোচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। শরীরের ভারে আলগা মাটি সরে যাচ্ছে।
একটু শব্দ হলো। বাইরের ফিসফিসানি থেমে গেল। আর্য্যক জমে গেল। হৃদপিণ্ড জোরে জোরে ধুকপুক করছে।
"কীসের শব্দ?" একজন পাহারাদার শুকনো গলায় প্রশ্ন করল।
অন্যজন উত্তর দিল, "কিছু না। হয়তো কোনো রাতচরা পাখি উড়ে গেল। শীত পড়ছে তো, সবদিকে শুকনো পাতা। শব্দ হয়ই।"
আহ্! বেঁচে গেল। আর্য্যক জানে, শীতের শুরুতে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে কেমন শব্দ হয়। পাহারাদাররা হয়তো ওটাই ভেবেছে।
সে আবার নড়তে শুরু করল। এবার দ্রুত। শরীর অর্ধেকটা বাইরে চলে এসেছে। শেষ ধাক্কা দিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। ঠান্ডা বাতাস লাগল গায়ে। সে দ্রুত শুয়ে পড়ল কুটিরের বেড়ার পাশে, অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল।
পাহারাদার দুজন কুটিরের সামনেই বসে আছে। তাদের একজন হাই তুলছে। আর্য্যক নিঃশব্দে মাটি দিয়ে বুকে হেঁটে কিছুটা দূরে সরে গেল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গাছের ছায়ার আড়ালে দাঁড়াল। সে মুক্ত!
কিন্তু মুক্তি মানেই নিরাপত্তা নয়। সে এখন পলাতক। বৃকাস নিশ্চয়ই জেনে যাবে যে সে পালিয়েছে। তখন সারা শৈলপ্রস্থে তার খোঁজ পড়বে।
প্রথমেই চারুলতা দিদার খোঁজ নিতে হবে। সে সাবধানে গ্রামের ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল। গ্রামের অন্য কুটিরগুলো থেকে আলো আসছে না। সবাই ঘুমিয়ে আছে অথবা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। বাতাস ভারী, যেন দমবন্ধ লাগছে।
চারুলতা দিদার কুটিরের সামনে এসে সে দেখল, সেখানেও দুজন পাহারাদার। তারা কাঠের একটা গুঁড়িতে বসে আছে। বৃকাস কোনো ঝুঁকি নেয়নি। চারুলতা দিদাকে উদ্ধার করা একা সম্ভব হবে না।
আর্য্যক একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। তার হাতে এখনও সেই ফলটা ধরা আছে। এই ফলটাই বৃকাসের মিথ্যের চাবিকাঠি। প্রমাণ। কিন্তু এই প্রমাণ দিয়ে কী করবে সে? গ্রামের লোকেরা এখন ভয়ে এতটাই জড়সড় যে তারা কোনো প্রমাণই বিশ্বাস করতে চাইবে না। বৃকাস যা বলবে, সেটাই মেনে নেবে।
হঠাৎ তার মনে এল, মৃগাঙ্ক! ছেলেটা হয়তো বৃকাসের সব গোপন কথা জানে। বৃকাস কখন তাকে কী খাওয়ায়, কী শেখায়। যদি মৃগাঙ্ককে বোঝানো যায়, যদি তার কাছ থেকে সত্যিটা বের করা যায়... কিন্তু সে তো বৃকাসের কড়া পাহারায় আছে।
আর্য্যক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। চারুলতা দিদা বন্দী। মৃগাঙ্ক বন্দী। সে নিজে পলাতক। বৃকাসের ক্ষমতা এখন অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু তাকে হাল ছাড়লে চলবে না। শৈলপ্রস্থকে বাঁচাতে হলে, এই রক্তরাঙা অধ্যায় থামাতে হলে তাকে কিছু একটা করতেই হবে। এমন কিছু যা বৃকাসের ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কী সেটা?
নর্মদার জলের শব্দ আসছে। সেই শব্দে আজ কোনো শান্তি নেই, আছে এক অন্তহীন প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে এই বসতি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে? কী করবে? তার হাতে ধরা ফলটা অন্ধকারে আরও কালচে মনে হচ্ছে, যেন আসন্ন বিপদের প্রতীক।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
শৈলপ্রস্থের বসতি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ভোরের ঠান্ডা বাতাস আর্য্যকের মুখে লাগল। অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি, কিন্তু পূব আকাশে হালকা আভা দেখা যাচ্ছে। বনের ভেতরের ঠান্ডা আর ভেজা গন্ধটা যেন তাকে স্বাগত জানাল। সে দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল, বসতির কাছাকাছি থাকা ঝোপঝাড় আর গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে। তার মনে কোনো নির্দিষ্ট পথ ছিল না, শুধু একটাই চিন্তা— বৃকাস তাকে ধরার আগেই যতটা সম্ভব দূরে চলে যেতে হবে।
সূর্য পুরোপুরি ওঠার আগেই আর্য্যক বনের গভীরে ঢুকে গেল। এমন এক জায়গায় সে আশ্রয় নিল যেখানে ঘন গাছপালা আর বড় বড় পাথর তাকে দিনের আলো থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারবে। জায়গাটা নদীর কাছেই, জলের কুলকুল শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু সে জানে, বৃকাসের অনুচররা এই অঞ্চলেও খুঁজে দেখবে। সে এখন পলাতক, বনের পশুর চেয়েও বেশি সাবধানে থাকতে হবে তাকে।
পেটে খিদে, শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মনটা সজাগ। কাল রাতের ঘটনাগুলো তার মাথায় ঘুরছে। চারুলতা দিদার মুখটা মনে পড়ল। কী ভয় ছিল না তার চোখে, কী অসীম সাহস নিয়ে সে সত্যিটা বলতে এসেছিল। আর বৃকাস! তার মুখটা রাগে আর ধরা পড়ার আশঙ্কায় বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আর মৃগাঙ্ক? ছেলেটা হয়তো এখনও ঘোরের মধ্যে আছে, অথবা বৃকাসের ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।
আর্য্যক তার কোমরের থলি থেকে সেই ফলটা বার করল। কাল রাতে তাড়াহুড়োয় সে শুধু একটা ফলই তুলে আনতে পেরেছিল। ভোরের আলোয় ফলটাকে আরও নিরীহ দেখাচ্ছে। ছোট, গোল, হালকা কাঁটা যুক্ত। এই সাধারণ ফলটাই বৃকাসের সব ক্ষমতার রহস্য। এই ফলই মানুষকে বিভ্রমের জগতে ঠেলে দেয়। আর মানুষ সেটাকেই আত্মার কথা বলে বিশ্বাস করে!
আর্য্যকের রাগ আর হতাশা একসাথে মিশে গেল। সে প্রমাণ পেয়েছিল। চারুলতা দিদা তার জ্ঞান দিয়ে সেটাকে সমর্থনও করেছিল। কিন্তু গ্রামের মানুষ ভয় আর অন্ধবিশ্বাসে এতটাই আচ্ছন্ন যে তারা সত্যিটা দেখতে চাইল না। বৃকাসের এক ধমকেই তারা আবার চুপ করে গেল।
সে একা। হাতে একটা ফল। একদিকে বৃকাসের শক্তি, তার অনুগত পাহারাদার, গ্রামের মানুষের ভয় আর অন্ধবিশ্বাস। অন্যদিকে সে নিজে— একজন পলাতক। কীভাবে সে এই জাল ছিঁড়ে ফেলবে? কীভাবে গ্রামের মানুষকে বোঝাবে যে তারা প্রতারিত হচ্ছে?
নদীর জলের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, এই নদী হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছে। মানুষের কত উত্থান-পতন, কত হাসি-কান্না, কত রক্তপাত সে দেখেছে! তার কাছে মানুষের এই ক্ষণিকের খেলা হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু শৈলপ্রস্থের মানুষের কাছে এটাই জীবন-মরণ সমস্যা।
আর্য্যকের মনে পড়ল শৈলপ্রস্থের পুরনো দিনের কথা। বৃকাস দলপতি হওয়ার আগে এমন ছিল না সবকিছু। তখন চারুলতা দিদার কথাই শেষ কথা ছিল রোগ-ব্যাধি বা প্রকৃতির মতিগতি নিয়ে। শিকারের নিয়মকানুন, বীজ বোনার সময়— সবকিছু চলত পুরনো প্রথা মেনে। ভয় তখনো ছিল, কিন্তু সেটা ছিল প্রকৃতির ভয়, জীবিকার অনিশ্চয়তার ভয়। মানুষের ভয় মানুষকে দিয়ে সৃষ্টি হতো না।
বৃকাস এসে সবকিছু বদলে দিয়েছে। সে পুরনো ভয়টাকে কাজে লাগিয়েছে নতুন এক ভয় তৈরি করার জন্য— নিজের ক্ষমতার ভয়। আর এই ভয়ের জন্ম দিয়েছে সেই ‘শামান’ আর ‘অশুদ্ধতা’র গল্প ফেঁদে।
আর্য্যক ফলটা হাতে নিয়ে ভাবল। এই ফলটা মৃগাঙ্ককে কেমন করে? আচ্ছন্ন করে তোলে, কথা বলায়। বৃকাস কি শুধু এটাই করে? নাকি আরও কিছু আছে? মৃগাঙ্ক কেন বারবার ওই রকম ছটফট করে, চোখ উল্টে যায়? সেটা কি শুধু এই ফলের জন্য? নাকি ওটা ওর আসল রোগ? আর বৃকাস সেই রোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে?
হঠাৎ তার মনে পড়ল, চারুলতা দিদা একদিন মৃগাঙ্কর অসুস্থতা নিয়ে কী যেন বলছিল। বলছিল, ছেলেটার শরীর মাঝে মাঝে Control করা যায় না। সেটা নাকি কোনো আত্মা ভর করার মতো নয়, সেটা শরীরের ভেতরকার কোনো গোলমাল। চারুলতা দিদা নাকি সেটার জন্য কিছু শেকড়বাকড়ের দাওয়াই দিত। কিন্তু বৃকাস আসার পর থেকে মৃগাঙ্কর ওই রকম হওয়াটা যেন আরও বেড়ে গেছে, আর সেটাকে ‘দৈবশক্তির প্রকাশ’ বলে প্রচার করা হচ্ছে।
তবে কি বৃকাস মৃগাঙ্কর রোগটাকেই উস্কে দিচ্ছে? এই ফলের রস দিয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে, আর রোগের সময়কার ছটফটানিকে আত্মার ভর বলে প্রচার করে? যদি এটা প্রমাণ করা যায় যে মৃগাঙ্কর ওই অসুস্থতা একটা স্বাভাবিক রোগ, আর বৃকাস সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে... কিন্তু সেটা প্রমাণ করবে কী করে? বিশেষ করে যখন মৃগাঙ্ককে তার নাগালের বাইরে রাখা হয়েছে।
আর্য্যকের মন বনের গভীরে চলে গেল। সে শিকারি। সে পশুপাখির গতিবিধি বোঝে, গাছের গুণাগুণ কিছুটা হলেও জানে। বনের কোথায় কী পাওয়া যায় তার নখদর্পণে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, শৈলপ্রস্থ থেকে কিছুটা দূরে, যেখানে নদীটা একটা বড় বাঁক নিয়েছে, সেখানে পাহাড়ের গায়ে একটা গোপন গুহা আছে। ছোটবেলায় সে আর তার কয়েকজন বন্ধু একবার সেখানে ঢুকেছিল। গুহাটা খুব গভীর নয়, কিন্তু বেশ খানিকটা নির্জন। সেখানে গেলে হয়তো নিরাপদ থাকা যাবে কিছুক্ষণ। আর সেই সঙ্গে ভাবা যাবে, কী করা যায়।
পালাতে চাইলে সে হয়তো অন্য কোনো বসতির দিকে চলে যেতে পারত। কিন্তু তার মন মানছে না। শৈলপ্রস্থ তার ঘর, তার মানুষ। চারুলতা দিদা বন্দী। মৃগাঙ্কর জীবন বিপন্ন। এই অবস্থায় সে তাদের ফেলে চলে যেতে পারবে না।
তাকে ফিরতেই হবে। কিন্তু ফিরবে কীভাবে? একা বৃকাসের শক্তিকে পরাস্ত করা যাবে না। গ্রামের মানুষকে পাশে পেতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন এমন কিছু যা তাদের ভয় আর অন্ধবিশ্বাসকে ভেঙে দেবে।
আর্য্যক থলির মধ্যে ফলটা carefully রেখে দিল। এটা প্রমাণ। কিন্তু যথেষ্ট নয়। তাকে আরও কিছু খুঁজতে হবে। এমন কিছু যা বৃকাসকে corner করে দেবে, যা মৃগাঙ্কর অসুস্থতার আসল কারণ প্রকাশ করে দেবে। অথবা এমন কোনো উপায় বের করতে হবে, যা দিয়ে বৃকাসের মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে অন্যভাবে লড়া যায়। পুরনো জ্ঞান, প্রকৃতির সত্য— এগুলো কি বৃকাসের মিথ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে?
আর্য্যক উঠে দাঁড়াল। গুহাটার দিকে রওনা দেওয়ার আগে সে একবার শৈলপ্রস্থের দিকে তাকাল। কুটিরগুলো আবছা দেখা যাচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে। সেখানে তার ঘর, তার মানুষজন। আর সেখানে চলছে এক ভয়ঙ্কর নাটক। নাটক শেষ হওয়ার আগেই তাকে তার ভূমিকা নিতে হবে।
সে নিশ্বাস ভরে নিল বনের ভেজা গন্ধের। তার শিরায় শিরায় বইছে পূর্বপুরুষদের রক্ত, যারা এই বন আর নদীকে ভালোবেসেছিল, সম্মান জানিয়েছিল। যারা ভয়ের কাছে মাথা নত করেনি।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
শৈলপ্রস্থ থেকে বেশি দূরে নয় গুহাটা, কিন্তু এত দুর্গম যে বৃকাস বা তার অনুচররা সাধারণত এইদিকে আসে না। পাহাড়ের গা বেয়ে, ঝোপঝাড় আর আলগা পাথরের ওপর দিয়ে সাবধানে পথ চলল আর্য্যক। ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটার আগেই সে গুহার মুখে পৌঁছাল। বিশাল এক পাথরের আড়ালে সরু একটা ফাঁক, তার ভেতরেই অন্ধকার গুহা।
ভেতরে ঢুকে প্রথমটায় কিছুই দেখা গেল না। ভিজে মাটির গন্ধ আর বদ্ধ বাতাস। আর্য্যক কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। ধীরে ধীরে গুহার ভেতরের পাথরের এবড়োখেবড়ো দেওয়ালগুলো স্পষ্ট হতে লাগল। বেশি বড় নয় গুহাটা, সামান্য ভেতরে গেলেই শেষ। কিন্তু রাতের আশ্রয় বা দিনের বেলা লুকানোর জন্য যথেষ্ট।
আর্য্যক গুহার ভেতরে কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটা শুকনো জায়গায় বসল। বাইরে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। বনের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দূর পাহাড়ে বুনো জন্তুর ডাক। এই শব্দগুলো আর্য্যকের খুব চেনা, খুব comforting। অন্তত এখানে মানুষের মিথ্যে আর ভয় নেই।
সে তার থলি থেকে সেই ফলটা বার করল। ছোট, কালচে রঙের ফল। হাতে নিয়ে ওটা সে উল্টেপাল্টে দেখল। কাল রাতে চারুলতা দিদা এই ফলটাকেই বৃকাসের মিথ্যের প্রমাণ বলেছিল। এই ফলের রসই মৃগাঙ্ককে আচ্ছন্ন করে, তাকে দিয়ে যা তা বলায়। আর বৃকাস সেটাকেই আত্মার নির্দেশ বলে চালিয়ে দেয়!
কিন্তু শুধু এই ফলটা দিয়ে কী হবে? গ্রামের মানুষ ভয়ে অন্ধ। তারা প্রমাণ দেখলেও বিশ্বাস করবে না। তারা বৃকাসকে ভয় পায়, বৃকাসের ঘোষিত 'শামান'কে ভয় পায়। তাদের ভয় ভাঙতে হলে আরও কিছু করতে হবে। এমন কিছু যা সরাসরি বৃকাসের ক্ষমতার মূলে আঘাত করবে।
আর্য্যকের মনে পড়ল মৃগাঙ্কর কথা। ছেলেটার সেই অসুস্থতা। চোখ উল্টে যাওয়া, শরীর বেঁকে যাওয়া, ছটফট করা। এটা শুধু ফলের রস খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকার মতো নয়। চারুলতা দিদা একবার বলেছিল, মৃগাঙ্কর শরীরে কীসের যেন একটা সমস্যা আছে। ছোটবেলা থেকেই এরকম হয় মাঝে মাঝে। তখন চারুলতা দিদা কিছু লতাপাতা বেটে খাওয়াত, তাতে নাকি ছেলেটা শান্ত হতো। বৃকাস আসার পর থেকে ছেলেটার অসুস্থতা আরও বেড়ে গেছে, অথবা বৃকাস ইচ্ছে করে সেটাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
হঠাৎ আর্য্যকের মাথায় একটা চিন্তা এল। মৃগাঙ্কর আসল রোগটা যদি সে সারিয়ে তুলতে পারে, অথবা অন্তত সেটাকে শান্ত করতে পারে? তাহলে কি বৃকাসের ‘শামান’ তকমাটা দুর্বল হয়ে যাবে? যদি মৃগাঙ্ককে ওই রকম ছটফট করতে না দেখা যায়, যদি সে স্বাভাবিক থাকে, তাহলে কি গ্রামের মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকবে?
কিন্তু মৃগাঙ্কর রোগ সারানোর ওষুধ কোথায় পাবে সে? চারুলতা দিদা জানত। কিন্তু চারুলতা দিদা তো এখন বন্দী।
আর্য্যক তার স্মৃতি হাতড়াতে লাগল। চারুলতা দিদা কী বলত? কোন লতাপাতার কথা বলত? শৈলপ্রস্থের আশেপাশে এমন অনেক গাছ আছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে শুধু গাছ, কিন্তু চারুলতা দিদার কাছে সেগুলো একেকটা ওষুধ। সে শিকারী হিসেবে অনেক গাছপালা চেনে, কিন্তু ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে তার জ্ঞান সীমিত।
সে ভাবল, চারুলতা দিদা সেই বিশেষ লতাটা কোথায় পেত? কি সেটার নাম? শান্তিলতা? না, অন্য কিছু? দিদা একবার বলছিল, ওই লতাটা নাকি সব জায়গায় পাওয়া যায় না। যেখানে পাহাড়ি ঝর্ণা আছে, যেখানে মাটি সবসময় ভেজা ভেজা আর ঠান্ডা থাকে, সেখানেই নাকি ওই লতাটা ভালো জন্মায়।
আর্য্যকের মনে পড়ল শৈলপ্রস্থ থেকে উজানের দিকে আরও কিছুটা গেলে একটা ছোট ঝর্ণা আছে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা। জায়গাটা সবসময় স্যাঁতসেঁতে। সেখানে কি সেই লতাটা থাকতে পারে?
এই চিন্তাটা তার মনে আশার আলো জাগাল। যদি সে সেই লতাটা খুঁজে বের করতে পারে, আর যদি সেটা সত্যিই মৃগাঙ্কর অসুস্থতা কমাতে পারে, তাহলে এটা হবে বৃকাসের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। প্রমাণ শুধু ফলটা নয়, প্রমাণ হবে মৃগাঙ্কর সুস্থ হয়ে ওঠা!
কিন্তু কাজটা সহজ নয়। প্রথমত, লতাটা খুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেটা যে মৃগাঙ্কর রোগ সারাবে বা শান্ত করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তৃতীয়ত, মৃগাঙ্কর কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। সে বৃকাসের কড়া পাহারায় আছে। আর শেষ কথা, তার কাছে সময় খুব কম। সাত পূর্ণিমার মধ্যে তাকে কিছু একটা করতে হবে।
কিন্তু আর কোনো পথ খোলা নেই আর্য্যকের সামনে। বৃকাসকে থামাতে হলে এটাই একমাত্র উপায়। অন্ধবিশ্বাসকে হারাতে হবে জ্ঞানের আলো দিয়ে, মিথ্যে প্রচারকে হারাতে হবে সত্যি প্রমাণ করে। আর তার জন্য দরকার সেই শান্তিলতা।
সে থলি থেকে সেই কালচে ফলটা বার করে গুহার এক কোণে রেখে দিল। এই ফলটা মিথ্যের প্রতীক। আর সে এখন খুঁজতে যাবে এমন কিছু যা সত্যের প্রতীক হতে পারে, আরোগ্য আর শান্তির প্রতীক।
আর্য্যক গুহার বাইরে বেরিয়ে এল। সকালের আলো বনের ভেতর এসে পড়েছে। পাখির ডাক আরও স্পষ্ট। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর নর্মদার উজানের দিকে, যেখানে সেই ঝর্ণাটা আছে, সেদিকে রওনা দিল। পথ দুর্গম, বিপদ পদে পদে। কিন্তু তার মনে এখন দৃঢ় সঙ্কল্প। তাকে খুঁজতে হবে সেই শান্তিলতা।
নবম পরিচ্ছেদ
গুহার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আর্য্যক চলল উজানের দিকে। পথ দুর্গম, পাথর আর কাঁটায় ভর্তি। মাঝে মাঝে তাকে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হচ্ছে, কখনো বা ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে পথ করে নিতে হচ্ছে। পায়ের নিচের আলগা মাটি সরে গেলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে সামলাচ্ছে সে। প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্ক, প্রতিটি মুহূর্ত সজাগ। সে এখন শুধু একজন শিকারি নয়, সে পলাতক।
নর্মদার জলের শব্দ কখনো কাছে, কখনো দূরে। নদীর বয়ে চলা অবিরাম। এই প্রকৃতি তার চেনা, তার আশ্রয়। কিন্তু আজ প্রকৃতির এই রুক্ষ সৌন্দর্য তার মনকে শান্তি দিতে পারছে না। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে শুধু শৈলপ্রস্থ— বন্দী চারুলতা দিদা, অসহায় মৃগাঙ্ক, আর বৃকাসের ভয়ঙ্কর ক্ষমতা।
সে সেই ঝর্ণাটার দিকে যাচ্ছে, যেখানে চারুলতা দিদা বলেছিল শান্তিলতা লতাটা পাওয়া যেতে পারে। যে লতা নাকি মৃগাঙ্কর শরীর শান্ত করতে পারত। পথে যেতে যেতে আর্য্যকের মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই লতাটা কি সত্যিই মৃগাঙ্কর রোগ সারাতে পারবে? যদি না পারে? যদি বৃকাস ততদিনে মৃগাঙ্কর আর চারুলতা দিদার ক্ষতি করে ফেলে?
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। আর কত পূর্ণিমা বাকি আছে, বৃকাস বলেছিল সাতটা পূর্ণিমার মধ্যে বলি হবে। কতগুলো কেটে গেছে বন্দী হওয়ার আগে? আর কতগুলো বাকি আছে? মনে রাখতে পারেনি সে। কিন্তু জানে, হাতে সময় কম।
অনেকটা পথ হাঁটার পর আর্য্যকের কানে জলের ঝর্ণার শব্দ এল। প্রথমে ক্ষীণ, তারপর ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। শব্দ অনুসরণ করে সে এগোতে লাগল। পথ আরও কঠিন হচ্ছে। বড় বড় বোল্ডার, মসৃণ পাথরের গা বেয়ে জল পড়ছে। জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, শেওলা ভর্তি। অবশেষে সে ঝর্ণাটার কাছে পৌঁছাল। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু একটা ধারা নিচে পাথরের ওপর এসে পড়ছে। চারপাশে ভেজা পাথর আর সবুজ vegetation। জায়গাটা শীতল, শান্ত। বসতির ভেতরের অস্থিরতা এখানে নেই।
এবার লতাটা খুঁজে বের করার পালা। চারুলতা দিদা বলেছিল, এটা নাকি ভেজা পাথরের গায়ে বা তার আশেপাশে জন্মায়। আর্য্যক সাবধানে ঝর্ণার চারপাশটা খুঁজতে শুরু করল। প্রতিটি নুড়ি পাথর, প্রতিটি গাছের শেকড় সে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা রয়েছে এখানে। কোনটি সেই শান্তিলতা? চারুলতা দিদা লতাটার চেহারা কেমন বলেছিল? ছোট পাতা? বেগুনি ফুল? মনে করার চেষ্টা করল সে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। খিদে পেয়েছে, শরীর ক্লান্ত। কিন্তু সে হার মানতে রাজি নয়। যদি লতাটা এখানেই না থাকে? যদি চারুলতা দিদা ভুল বলে থাকে, অথবা বৃকাস অন্য কোথাও থেকে আনে? হতাশায় তার মন ভরে উঠতে লাগল।
ঠিক তখনই, একটা বড় পাথরের আড়ালে, যেখানে ঝর্ণার জল ছিটকে এসে পড়ছে সবসময়, সেখানে তার চোখ আটকে গেল। ছোট্ট একটা লতা পাথরের গা বেয়ে উঠেছে। পাতাগুলো সরু, লম্বাটে। আর তার ডগায় ছোট ছোট সাদাটে ফুল। আর্য্যকের মনে হল, চারুলতা দিদা কি এইরকমই কিছুর কথা বলেছিল? নামটা মনে পড়ছে না, কিন্তু এই লতাটা কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছে। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ ভাব আছে লতাটার মধ্যে।
সে নিচু হয়ে লতাটার কাছে গেল। সাবধানে হাত দিয়ে স্পর্শ করল পাতাগুলো। ভিজে, ঠান্ডা। এই লতাটাতেই কি লুকানো আছে বৃকাসের মিথ্যের জবাব?
আর্য্যক চারপাশের আর কয়েকটা জায়গায় খুঁজতে লাগল। দেখল, হ্যাঁ, আরও কিছু জায়গায় এই লতাটা জন্ম নিয়েছে, তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। এটাই কি সেই শান্তিলতা? নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই চারুলতা দিদা ছাড়া। কিন্তু তার মন বলছে, এটাই হতে পারে। এই নির্জন, পবিত্র ঝর্ণার ধারে জন্মানো এই লতাটা, যা সহজে পাওয়া যায় না— এটাই হয়তো প্রকৃতির দেওয়া আসল নিরাময়, যা বৃকাসের কৃত্রিম ফলের বিষণ্ণতার ঠিক বিপরীত।
সে সাবধানে লতাটার গোড়া থেকে শিকড় সমেত কিছুটা তুলে নিল। যতটা প্রয়োজন হতে পারে, ততটাই নিল। তারপর সেগুলোকে carefully তার থলির মধ্যে রাখল, সেই ফলটা থেকে আলাদা করে।
এখন তার হাতে দুটো জিনিস। একটা বৃকাসের মিথ্যের প্রতীক— সেই কালচে ফল। আরেকটা তার আশার প্রতীক— এই ভিজে শান্তিলতা। কিন্তু শুধু এই দুটো জিনিস দিয়ে সে কী করবে?
ঝর্ণার ধারে বসে আর্য্যক দূরের শৈলপ্রস্থের দিকে তাকাল। পাহাড় আর বনের আড়ালে লুকিয়ে আছে তার গ্রাম। সেখানে বন্দী তার আপনজন। সেখানে চলছে এক ভয়ঙ্কর খেলা। তাকে ফিরতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে সে পাহারাদারদের চোখ এড়িয়ে চারুলতা দিদা বা মৃগাঙ্কর কাছে পৌঁছাবে? কীভাবে প্রমাণ করবে যে বৃকাস মিথ্যা বলছে?
তার সামনে এখন দুটো কঠিন পথ। এক, এই শান্তিলতা দিয়ে মৃগাঙ্কর চিকিৎসা করার চেষ্টা করা। দুই, এই লতা আর ফল দুটোকে ব্যবহার করে গ্রামের মানুষকে বোঝানো। দুটো পথই অত্যন্ত বিপদজনক।
সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে। বনের গভীরেও আলো এসে পড়েছে। আর্য্যকের আর এখানে বসে থাকার সময় নেই। তাকে আবার রওনা দিতে হবে। কোথায় যাবে সে? সরাসরি শৈলপ্রস্থে ফেরা আত্মহত্যার সমান। কিন্তু তার মনে হয়েছে, এই লড়াইটা লড়তে হলে তাকে শৈলপ্রস্থের কাছাকাছিই থাকতে হবে। হয়তো নতুন কোনো আশ্রয় খুঁজতে হবে, যেখানে লুকিয়ে থেকে সে পরিস্থিতি বুঝতে পারবে, সুযোগের অপেক্ষা করতে পারবে।
সে উঠে দাঁড়াল। হাতে ধরা থলিটা আরও শক্ত করে ধরল। তার ভেতর এখন শুধু শুকনো ফল আর ভেজা লতা নয়, তার ভেতর আছে শৈলপ্রস্থকে বাঁচানোর এক অদম্য সঙ্কল্প। আর্য্যক আবার পথ চলা শুরু করল, এবার শৈলপ্রস্থের দিকে নয়, শৈলপ্রস্থের কাছাকাছি কোনো গোপন আস্তানার খোঁজে।
দশম পরিচ্ছেদ
ঝর্ণার ধার থেকে ফিরে আর্য্যক শৈলপ্রস্থের একেবারে কাছে চলে এল। তবে বসতির ভেতরে নয়, চারপাশে থাকা উঁচু টিলাগুলোর একটিতে সে তার নতুন আস্তানা খুঁজে নিল। জায়গাটা বেশ নিরাপদ— ঘন ঝোপ আর পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা ছোট গর্ত। এখান থেকে পুরো শৈলপ্রস্থটা দেখা যায়, অথচ কেউ তাকে দেখতে পাবে না। এ যেন প্রকৃতির Watchtower।
এখানে বসে আর্য্যক দিনরাত শৈলপ্রস্থকে লক্ষ্য করতে লাগল। তার পালানোর খবর নিশ্চয়ই বৃকাসের কানে পৌঁছে গেছে। গ্রামের ভেতর উত্তেজনা বেড়েছে। দিনের বেলা মানুষজনের চলাফেরা কমে গেছে, রাতের নিস্তব্ধতা আরও গভীর। বসতির কেন্দ্রে বৃকাসের কুটিরের আশেপাশে পাহারাদারদের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের হাতে বাঁশের লাঠি, মুখে চোখে বিরক্তি আর সতর্কতা।
চারুলতা দিদার কুটিরের সামনেও দুজন পাহারাদার। মৃগাঙ্কর কুটিরটাকে যেন দুর্গের মতো ঘিরে রাখা হয়েছে। কয়েকজন শক্তিশালী লোক পালা করে পাহারা দিচ্ছে। বোঝা যায়, বৃকাস মৃগাঙ্ককে এখন তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে মনে করছে। শামান হাতছাড়া হয়ে গেলে তার ক্ষমতার ভিত্তি নড়ে যাবে।
আর্য্যক দেখল, গ্রামের মানুষজন এখন আগের চেয়েও বেশি ভয় পেয়েছে। তাদের মুখে কোনো কথা নেই, চোখে শুধু আতঙ্ক। তারা যেন বৃকাসের প্রতিটি কথায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে— যে আর্য্যকই সেই অশুদ্ধতা, সেই পূর্বপুরুষদের রুষ্ট করেছে। ভয় মানুষকে কত সহজে অন্ধ করে দেয়!
একদিন বিকেলে আর্য্যক দেখল, বৃকাস গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। লোকজন জড়ো হয়ে শুনছে। এত দূর থেকে কথা শোনা সম্ভব নয়, কিন্তু বৃকাসের অঙ্গভঙ্গি আর উত্তেজিত মুখ দেখেই বোঝা যায়, সে ভয় দেখাচ্ছে। সম্ভবত তার পালানোটাকেই নতুন করে ব্যাখ্যা করছে সে। বলছে, অশুভ আত্মা আর্য্যকের ওপর ভর করেছে, সে পালিয়ে গিয়ে বনের গভীরে লুকিয়ে আছে, গ্রামের অমঙ্গলের জন্য অপেক্ষা করছে। আর এই অমঙ্গল থেকে বাঁচতে হলে দেবতাদের খুশি করা জরুরি। অর্থাৎ, বলির সময় এগিয়ে আসছে।
আর্য্যকের বুকের ভেতরটা জমে গেল। বৃকাস তার পালানোটাকেও নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করছে। তাকে villain বানিয়ে গ্রামের মানুষের ভয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন হয়তো বৃকাস বলির তারিখ আরও এগিয়ে আনবে, বা বলি দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে কারো নাম ঘোষণা করবে। হয়তো চারুলতা দিদার নামই ঘোষণা করবে!
চিন্তায় আর্য্যকের মাথা গরম হয়ে গেল। সে এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে বসে থাকবে? তার হাতে দুটো জিনিস— সেই কালচে ফল আর শান্তিলতা। ফলটা প্রমাণ করে বৃকাস মিথ্যাবাদী। শান্তিলতা হয়তো মৃগাঙ্কর রোগ শান্ত করতে পারে। কিন্তু কীভাবে এই দুটো জিনিসকে সে কাজে লাগাবে?
মৃগাঙ্কর কাছে পৌঁছানো অসম্ভব। তার কুটির পাহারায় ঘেরা। চারুলতা দিদার কাছে যাওয়াও কঠিন। পাহারাদাররা সব সময় সতর্ক। আর গ্রামের মানুষ? তারা তো এখন তাকেই ভয় পাচ্ছে। তার সামনে গিয়ে সত্যিটা বলতে গেলে হয়তো তারাই বৃকাসের হাতে তুলে দেবে।
রাতের অন্ধকারে শৈলপ্রস্থের কুটিরগুলোতে যখন আগুন জ্বলে, আর্য্যক টিলার ওপর বসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে দেখলে গ্রামটাকে শান্ত মনে হয়, কিন্তু সে জানে এর ভেতরটা কতটা অস্থির, কতটা ভীত। চাঁদের আলোয় নর্মদার জল চিকচিক করে। কিন্তু সেই আলোয় আর্য্যকের চোখে ঘুম আসে না।
তাকে একটা পথ বের করতেই হবে। একটা সুযোগ খুঁজতে হবে। পাহারাদারদের অসতর্ক মুহূর্ত, বৃকাসের কোনো ভুল, অথবা গ্রামের মানুষের ভয় যখন চরমে উঠবে, সেই মুহূর্তটাই হয়তো তার সুযোগ।
কিন্তু সুযোগ কখন আসবে, কীভাবে আসবে, তা সে জানে না। তার হাতে সময় কম। প্রতিটি পূর্ণিমা চক্র এগিয়ে আসছে। সেই রক্তরাঙা পূর্ণিমা বেশি দূরে নেই।
আর্য্যক তার থলির ভেতর হাত দিল। কালচে ফলটা হাতে নিয়ে তার ভেতরটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। শান্তিলতা লতাটা স্পর্শ করে কিছুটা শান্তি পেল। একটা মিথ্যে, একটা সত্যি। এই দুটো জিনিসই এখন তার সম্বল। আর আছে তার নিজের বুদ্ধি আর সাহস।
টিলার ওপর বাতাস বইছে। বনের শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করছে। আর্য্যক শৈলপ্রস্থের দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা। তাকে ফিরতেই হবে। শৈলপ্রস্থকে বাঁচাতে হলে তাকে বৃকাসের মুখোশ খুলে দিতে হবে। কিন্তু সেই পথ রক্তের দাগে রাঙা হতে পারে, এই আশঙ্কা তার মনে স্পষ্ট।
একাদশ পরিচ্ছেদ
টিলার ওপর বসে প্রতিটি দিন আর রাত আর্য্যক শৈলপ্রস্থকে পর্যবেক্ষণ করছে। সময় গড়িয়ে চলেছে, আর তার সাথে সাথে বাড়ছে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। আকাশে চাঁদের আকার বদলাচ্ছে। আর কটা পূর্ণিমা বাকি আছে? আর্য্যকের মনে নেই হিসেবটা, কিন্তু সে জানে হাতে সময় খুব কম। বৃকাসের মুখের দিকে তাকালেই সে বোঝে, বলির সময় বেশি দূরে নেই।
গ্রামের ভেতরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ভয় এখন শুধু চাপা নয়, সেটা যেন একটা দৃশ্যমান রূপ ধারণ করেছে। মানুষজন একে অপরের সাথে কথা বলতে ভয় পায়। শিশুরা হাসে না। বাতাস ভারী। বৃকাস তার ক্ষমতা আরও বেশি করে দেখাচ্ছে। পাহারাদারদের সংখ্যা বাড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই সে গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলছে, তার গম্ভীর স্বর টিলার ওপর থেকেও আবছা শোনা যায়। তার কথার অর্থ পরিষ্কার— অমঙ্গল কেটে যায়নি, আর্য্যকের মতো দুষ্ট শক্তিরা এখনও লুকিয়ে আছে, আর তাদের শাস্তি দিতে হবে, আত্মাদের সন্তুষ্ট করতে হবে।
আর্য্যক বুঝতে পারছে, বৃকাস তাকে নিয়ে গল্প বানাচ্ছে। তাকে ভয়ের প্রতীক বানিয়ে মানুষের মনে তার বিরুদ্ধে থাকা সামান্য সহানুভূতিও নষ্ট করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষের কাছে গিয়ে সত্যিটা বলার কোনো মানে হয় না। তারা শুনবে না, শুনলেও বিশ্বাস করবে না।
তাকে অন্য পথ নিতে হবে। তার হাতে আছে দুটো জিনিস— মিথ্যের প্রমাণ (সেই ফল) আর আশার আলো (শান্তিলতা)। এই দুটো জিনিসকে কাজে লাগাতে হলে তাকে হয় মৃগাঙ্কর কাছে পৌঁছাতে হবে, নয় চারুলতা দিদার কাছে।
মৃগাঙ্ককে পাহারা দিচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুচরেরা। তার কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাকে মুক্ত করার চেষ্টাও বৃথা, কারণ ছেলেটা অসুস্থ, হয়তো পালানোর ধকল সইতে পারবে না। তাছাড়া, শান্তিলতা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা আর্য্যক জানে না।
চারুলতা দিদা। তিনিই জানেন শান্তিলতা কীভাবে তৈরি করতে হবে, মৃগাঙ্কর রোগ সম্পর্কে তিনি জানতেন। চারুলতা দিদাকে মুক্ত করতে পারলে তার জ্ঞান কাজে লাগবে। তিনিই হয়তো গ্রামের মানুষকে বোঝানোর সঠিক উপায় বাতলে দিতে পারবেন। হ্যাঁ, তাকে চারুলতা দিদার কাছেই যেতে হবে।
কিন্তু চারুলতা দিদার কুটিরও পাহারায় ঘেরা। দুজন লোক সব সময় কুটিরের সামনে বসে থাকে। তারা হয়তো বৃকাসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক নয়, কিন্তু তারা সতর্ক।
কয়েক রাত ধরে আর্য্যক পাহারাদারদের লক্ষ্য করল। তাদের রুটিন বোঝার চেষ্টা করল। কখন তারা একটু ঝিমিয়ে পড়ে? কখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত হয়? ভোরের ঠিক আগে, যখন প্রকৃতি নিস্তব্ধ থাকে আর মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, তখন পাহারাদাররা একটু অন্যমনস্ক হয়। শীতের রাতে আগুনের পাশে বসে থাকতে থাকতে তাদের চোখ লেগে আসে। এটাই সুযোগ!
ঝুঁকিটা মারাত্মক। ধরা পড়লে আর্য্যকের মৃত্যু নিশ্চিত। হয়তো তাকেই বলি দেওয়া হবে। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। তাকে চেষ্টা করতেই হবে।
সে তার ধনুক আর ছুরি তৈরি রাখল। কোমরের থলিতে সেই ফলটা আর শান্তিলতা carefully রাখল। শরীর আর মনকে প্রস্তুত করল আসন্ন বিপদের জন্য। অপেক্ষা করতে লাগল রাতের অন্ধকারের জন্য।
পূর্ণিমা কেটে গেছে, চাঁদ এখন ক্ষয়িষ্ণু। রাতের আকাশ বেশ অন্ধকার। তারাদের আলো আবছা। আর্য্যক তার গোপন আস্তানা ছেড়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করল। বনভূমির ছায়াগুলো যেন তাকে আড়াল করে রেখেছে। তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না, সে নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে।
শৈলপ্রস্থ কাছে আসছে। প্রথম কুটিরগুলো দেখা যাচ্ছে। সব অন্ধকার। নিস্তব্ধতা ভয়ঙ্কর। এই নিস্তব্ধতা মৃত্যুর মতো নয়, এটা যেন চাপা উত্তেজনার শ্বাস বন্ধ করা অবস্থা।
আর্য্যক গ্রামের একেবারে প্রান্তে এসে দাঁড়াল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখল। দূরে বৃকাসের কুটিরের সামনে আগুন জ্বলছে, সেখানে পাহারাদাররা বসে আছে। চারুলতা দিদার কুটিরের সামনেও আলো দেখা যাচ্ছে। দুজন লোক কুটিরের দরজার সামনে বসে আছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে।
আর্য্যক চারুলতা দিদার কুটিরের দিকে এগোতে শুরু করল। প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করা। মাটিতে শুকনো পাতা বা কাঠি পড়লেও শব্দ হতে পারে। সে নিচু হয়ে মাটির কাছাকাছি থাকছে। তার শরীরের প্রতিটি পেশী টানটান হয়ে আছে।
পাহারাদার দুজনের কাছাকাছি এসে সে থামল। তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। তাদের গলা ক্লান্ত। আর্য্যক তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। একজন একবার হাই তুলল। অন্যজন হাই তুলল। শীতের রাতের নিস্তব্ধতা আর আগুনের আরাম তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
এই মুহূর্ত!
আর্য্যক নিঃশ্বাস বন্ধ করল। শরীরটাকে আরও নিচু করে সে অন্ধকারের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল। তার লক্ষ্য— পাহারাদারদের পাশ কাটিয়ে চারুলতা দিদার কুটিরের দরজার কাছে পৌঁছানো। তার হাতে ধরা ছুরিটা শক্ত হয়ে উঠল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
অন্ধকার রাত। বাতাস থমথমে। আর্য্যক চারুলতা দিদার কুটিরের সামনে থাকা পাহারাদার দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা কাঠের গুঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে। আগুনের আঁচ নিভে গেছে প্রায়। তাদের গলা ক্লান্ত, মাঝে মাঝে হাই তুলছে। এটাই সুযোগ। এই রাতের শেষ প্রহর, যখন শরীর আর মন সবচেয়ে দুর্বল থাকে।
আর্য্যক নিচু হয়ে মাটির খুব কাছাকাছি চলে এল। মাটির ঠান্ডা স্পর্শ তার ত্বকে লাগছে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে এগোচ্ছে। বনভূমির ভেতর দিয়ে আসার সময় পায়ের নিচে শুকনো পাতা পড়লে শব্দ হত, কিন্তু এখানে মাটি নরম, ঘাস আছে কিছু কিছু জায়গায়। তার শরীর শিকারির মতো নমনীয়, পেশীগুলো টানটান। প্রতিটি ইঞ্চি সে হিসেব করে এগোচ্ছে।
পাহারাদার দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের কথার টুকরো আবছা ভেসে আসছে – খিদে, ঠান্ডা, আর বৃকাসের কড়া হুকুমের বিরক্তি। তাদের মনোযোগ নিজেদের কষ্টের দিকেই বেশি। আর্য্যক এই সুযোগটা কাজে লাগাল।
পাহারাদারদের পাশ কাটিয়ে সে নিঃশব্দে কুটিরের দরজার কাছে চলে এল। দরজাটা ভেতর থেকে শেকল দিয়ে আটকানো থাকার কথা নয়, পাহারাদাররাই বাইরে থেকে পাহারা দিচ্ছে। দরজাটা শুধু ভেজানো। আর্য্যক সাবধানে হাত দিয়ে দরজার কপাট ধরল। সামান্য চাপ দিতেই কপাট খুলে গেল ভেতরের দিকে। কোনো শব্দ হল না।
ভেতরে নিকষ অন্ধকার আর ভ্যাপসা গন্ধ। শুকনো লতাপাতা, মাটি আর পুরনো মানুষের শরীরী গন্ধ মিশে আছে। আর্য্যক ভেতরে পা রাখল। দরজার কপাটটা সামান্য ফাঁক করে রাখল, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত বের হতে পারে।
"দিদা?" সে খুব চাপা গলায় ডাকল।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ এল না। আর্য্যক আরও কিছুটা ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারে তার চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে দেখল, চারুলতা দিদা মেঝের ওপর শুয়ে আছে। শরীরটা রোগা হয়ে গেছে।
"দিদা! আমি আর্য্যক।" সে বৃদ্ধার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল।
চারুলতা দিদা নড়ে উঠল। প্রথমে হয়তো ভয় পেয়েছিল। তারপর তার জীর্ণ হাত আর্য্যকের মুখে স্পর্শ করল। "আর্য্যক! তুই... তুই এসেছিস!" তার গলায় বিস্ময় আর আকুতি।
"হ্যাঁ দিদা। আমি পালিয়ে এসেছি। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।"
চারুলতা দিদা উঠে বসার চেষ্টা করল। আর্য্যক তাকে সাহায্য করল। বৃদ্ধা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। "আমি জানতাম তুই আসবি," চারুলতা দিদা ফিসফিস করে বলল। "কিন্তু... কীভাবে? পাহারাদাররা..."
"ওদের পাশ কাটিয়ে এসেছি," আর্য্যক দ্রুত বলল। "বেশি কথা বলার সময় নেই। আমাদের এখনই বেরোতে হবে।"
"কোথায় যাবি?"
"বনে। গুহায়। নিরাপদ জায়গায়। আমার কাছে শান্তিলতা আছে, দিদা। সেই লতাটা, যা মৃগাঙ্কর... আপনাকে সেটা তৈরি করে দিতে হবে।" আর্য্যক তার থলি থেকে শান্তিলতা বার করে বৃদ্ধার হাতে দিল।
চারুলতা দিদা শুকনো হাতে লতাটা স্পর্শ করল। অন্ধকারেও যেন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। "শান্তিলতা! হ্যাঁ! এটা তো... এটা তো খুব জরুরি! কিন্তু শুধু লতা দিয়ে হবে না, বাছা। আরও কিছু জিনিস লাগবে। আর এটা তৈরি করার বিশেষ নিয়ম আছে। বৃকাস এসব জানে না। তার ওই ফল... ওটা তো শুধু আচ্ছন্ন করে মানুষকে।"
"জানি দিদা। তাই তো আপনার কাছে এসেছি। কিন্তু এসব কথা পরে হবে। আগে এখান থেকে বেরোই।" আর্য্যক চারুলতা দিদার হাত ধরল। "উঠুন।"
বৃদ্ধা ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু শরীর যেন সঙ্গ দিচ্ছে না। "আমি... আমি বোধহয় হাঁটতে পারব না, বাছা। শরীর চলছে না।"
আর্য্যক বুঝল বিপদ। চারুলতা দিদার শারীরিক অবস্থা যা, তাতে তাকে নিয়ে পাহারাদারদের পাশ কাটিয়ে দৌড়ানো অসম্ভব।
ঠিক তখনই বাইরে একটা খসখস শব্দ হল। পাহারাদার দুজন নড়েচড়ে উঠেছে। তাদের একজন শুকনো কাশির শব্দ করল।
চারুলতা দিদা আর্য্যকের হাত চেপে ধরল। "ওরা জেগে গেছে!"
আর্য্যকের হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে ছুটছে। সে উঠে দরজার কাছে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, পাহারাদার দুজন কুটিরের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের একজন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তারা কি কোনো শব্দ শুনেছে?
আর্য্যক বুঝতে পারল, পালানোর সুযোগ আর নেই। অন্তত এই মুহূর্তে নেই। সে আর চারুলতা দিদা একসাথে বের হওয়ার চেষ্টা করলে ধরা পড়ে যাবেই। আর ধরা পড়লে সব শেষ। বৃকাস ওদের দুজনকেই হত্যা করবে।
হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা এল। একটা ভয়ঙ্কর, প্রায় অসম্ভব চিন্তা।
সে চারুলতা দিদার কাছে ফিরে এল। বৃদ্ধা ভয়ে কাঁপছে। "কী করবি, বাছা? ওরা এসে পড়বে।"
"দিদা," আর্য্যকের গলা দৃঢ়। "আপনাকে এখানে থাকতে হবে।"
চারুলতা দিদা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। "মানে?"
"আমি একা বেরোব। পাহারাদারদের অন্য দিকে টেনে নিয়ে যাব। ওরা আমার পেছনে ছুটবে। এই সুযোগে আপনি... আপনি যদি কোনোমতে... লুকিয়ে পড়তে পারেন। পরে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।"
"না!" চারুলতা দিদা চিৎকার করে উঠল। "তুই একা ওদের সাথে পারবি না। বৃকাসের অনেক লোক। তুই ধরা পড়ে যাবি।"
"আমার চেয়ে আপনার বেঁচে থাকা বেশি জরুরি, দিদা। আপনি শান্তিলতা তৈরির নিয়ম জানেন। আপনি গ্রামের মানুষের ভরসা। আমাকে ধরা পড়লে শুধু আমি মরব। কিন্তু আপনি ধরা পড়লে শৈলপ্রস্থের সব আশা শেষ হয়ে যাবে।" আর্য্যকের সিদ্ধান্ত কঠিন, কিন্তু পরিষ্কার।
বাইরে পাহারাদারদের গলার স্বর আরও স্পষ্ট হচ্ছে। একজন দরজার কাছে চলে এসেছে।
আর্য্যক আর দেরি করল না। সে চারুলতা দিদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, "লতাটা লুকিয়ে রাখুন, দিদা। খুব সাবধানে থাকবেন। আমি ফিরব।"
তারপর সে শান্তিলতা আর সেই ফলটা তার থলিতে রাখল। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে, পাহারাদার দরজার কাছাকাছি আসার আগেই, আর্য্যক ঝড়ের বেগে কুটিরের অন্য দিকের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে গেল। একটা মট করে শব্দ হল।
"ওদিকে!" পাহারাদারদের একজন চিৎকার করে উঠল। "কেউ পালিয়েছে!"
আলো নিয়ে বাকি পাহারাদাররা ছুটে এল। কিন্তু আর্য্যক ততক্ষণে অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেছে। তার পালানোটা বৃকাসের মনোযোগ তার আর চারুলতা দিদার কাছ থেকে অন্য দিকে সরিয়ে দেবে। চারুলতা দিদা যদি এই সুযোগে লুকিয়ে পড়তে পারেন, যদি বৃকাস না জানতে পারে যে আর্য্যক তার সাথে দেখা করতে এসেছিল...
আর্য্যক দৌড়াচ্ছে। পেছনে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আলো দেখা যাচ্ছে কুটির থেকে কুটিরে জ্বলে উঠছে। গ্রামের ঘুম ভেঙে গেছে। বৃকাস নিশ্চয়ই তার অনুচরদের নির্দেশ দিচ্ছে আর্য্যককে ধরার জন্য।
সে আবার পলাতক। এবার আর শুধু বৃকাসের থেকে পালাচ্ছে না, সারা গ্রামের ভয় আর অন্ধবিশ্বাস থেকেও পালাচ্ছে। তার হাতে শান্তিলতা আর কালচে ফল। তার মনে চারুলতা দিদার মুখ আর মৃগাঙ্কর অসহায় চেহারা। আর্য্যক জানে, এই পালানোই শেষ নয়। এটা নতুন এক লড়াইয়ের শুরু।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ঝড়ের বেগে কুটিরের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এল আর্য্যক। শুকনো ডালপালা ভাঙার মটমট শব্দ রাতের স্তব্ধতা চিরে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাহারাদারদের চিৎকার। "ওদিকে! ও পালাচ্ছে!"
আর্য্যক আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। সে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। গ্রামটা গোল করে সাজানো, মাঝখানে খোলা জায়গা। সে দ্রুত ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে কুটিরগুলোর পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছে। অন্ধকারে পথ তার চেনা। প্রতিটি কুটিরের অবস্থান, প্রতিটি বড় পাথর, প্রতিটি গাছের শেকড় তার মুখস্থ। পেছনে পাহারাদারদের পায়ের শব্দ, তাদের চিৎকারের প্রতিধ্বনি।
গ্রামের ঘুম ভেঙে গেছে। কুটিরগুলোর দরজা খুলছে। মানুষজন আলো হাতে বা খালি হাতে বেরিয়ে আসছে। ভয় মেশানো চোখে দেখছে পলাতক আর্য্যককে। তাদের চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বৃকাসের গলা শোনা গেল— তীব্র, আদেশসূচক। "ধর ওকে! কেউ পালাতে দিবি না! ও শয়তান! ও আমাদের অভিশাপ!"
আর্য্যকের মনে হলো যেন পুরো শৈলপ্রস্থ তার পেছনে ছুটছে। কিন্তু সে থামল না। তার ভেতরের শিকারি instincts জেগে উঠেছে। সে বনের পশুর মতো দৌড়াচ্ছে, শরীর হালকা, মন সজাগ। গ্রামের শেষ কুটিরগুলো পেরিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বনের অন্ধকারে।
বন তার মিত্র। এখানে গাছের ছায়া তাকে আড়াল দেয়, ঝোপঝাড় তাকে পথ দেখায়। পেছনে যারা ছুটছে, তারা হয়তো শারীরিক শক্তিতে তার সমান, কিন্তু এই বনের প্রতিটি ইঞ্চি আর্য্যকের মতো তাদের চেনা নয়। সে আঁকাবাঁকা পথে ছুটতে লাগল, কখনো নিচু হয়ে ঝোপের তলা দিয়ে, কখনো গাছের ডালে ভর দিয়ে। তার উদ্দেশ্য ছিল নর্মদার দিকে যাওয়া। নদীর জল গন্ধ মুছে দেয়, পদচিহ্ন ঢেকে দেয়।
পেছনের পায়ের শব্দ ক্রমশ কমে আসছে। গ্রামের আলো আর চিৎকার পেছনে পড়ে রইল। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে বৃকাসের অবিরাম গর্জন। সে হয়তো রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আর হবে নাই বা কেন? আর্য্যক শুধু পালায়নি, সে তার ক্ষমতার কেন্দ্রে ঢুকে আঘাত করে এসেছে। চারুলতা দিদার কাছে সে গিয়েছিল। বৃকাস এখন নিশ্চিত যে তারা একসাথে কাজ করছে।
নদীর ধারে এসে আর্য্যক ঝাঁপ দিল ঠান্ডা জলে। শীতের শুরুতে জল বরফের মতো ঠান্ডা। শরীর অবশ হয়ে আসছে মনে হলো। কিন্তু সে সাঁতরে অন্য পাড়ে চলে গেল। ঠান্ডা জল তার গা থেকে সব গন্ধ মুছে দিল, হয়তো বৃকাসের অনুচরদের tracking আরও কঠিন করে দেবে।
অন্য পাড়ে উঠে সে ঘন ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিল। শরীর কাঁপছে ঠান্ডায় আর পরিশ্রমে। দম নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। সে কান পেতে রইল। কোনো শব্দ আসছে না। মনে হচ্ছে, পাহারাদাররা নদীর এপারে আসার সাহস করেনি অথবা তারা অন্য কোথাও খুঁজে দেখছে। আপাতত সে নিরাপদ।
কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না। চারুলতা দিদা! তার কী হলো? সে কি লুকিয়ে পড়তে পারল? নাকি বৃকাস এসে তাকে আবার বন্দী করেছে? সম্ভবত আরও কড়া পাহারায় রেখেছে। আর্য্যকের ব্যর্থতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সে চারুলতা দিদাকে মুক্ত করতে পারেনি। উল্টে তাকে আরও বিপদে ফেলে এসেছে।
কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। চারুলতা দিদার শারীরিক অবস্থা যা ছিল, তাতে তাকে নিয়ে পালানো অসম্ভব ছিল। ধরা পড়লে দুজনকেই মরতে হতো। অন্তত এখন চারুলতা দিদার বাঁচার একটা ক্ষীণ আশা আছে। যদি সে লুকিয়ে পড়তে পারে। অথবা যদি বৃকাস আর্য্যকের পালানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে।
আর্য্যক তার কোমরের থলিটা পরীক্ষা করল। হ্যাঁ, শান্তিলতা আর সেই কালচে ফল— দুটোই আছে। প্রমাণ আর সম্ভাব্য নিরাময়। সে মুক্ত, তার হাতে হাতিয়ার আছে। কিন্তু কীভাবে সে এই হাতিয়ার ব্যবহার করবে? তার পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বৃকাস এখন আরও সতর্ক। গ্রামের মানুষ তাকে এখন ভয়ের মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখছে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে প্রথম আলো এসে পড়ছে মাটির ওপর। আর্য্যক জানে, দিনের আলো ফোটার পর বৃকাস নিশ্চয়ই বড় আকারের অনুসন্ধান দল পাঠাবে। তাকে এখান থেকে আরও দূরে, আরও গভীরে চলে যেতে হবে।
কিন্তু শুধু পালিয়ে বেড়ানো সমাধান নয়। তাকে ফিরতেই হবে। শৈলপ্রস্থকে বাঁচাতে হলে তাকে বৃকাসকে থামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? আগের চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক বেশি কঠিন। তার হাতে কোনো সুযোগ নেই, কোনো মিত্র নেই (চারুলতা দিদা যদি না বেঁচে থাকেন)।
হতাশার একটা ঠান্ডা স্রোত আর্য্যকের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। এই আদিম শক্তি, এই অন্ধ বিশ্বাস, এই ভয়... এর বিরুদ্ধে সে একা কী করতে পারে?
কিন্তু যখন সে নর্মদার দিকে তাকাল, দেখল জলের ধারা অবিরাম বয়ে চলেছে, কোনো বাঁধ মানে না, কোনো ভয় মানে না। তার মনে পড়ল চারুলতা দিদার শান্ত মুখটা, তার অদম্য সাহস। সে হাল ছাড়েনি। আর্য্যকও হাল ছাড়বে না।
তার পালানোর ঘটনা বৃকাসকে ক্ষুব্ধ করেছে। গ্রামের মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু হয়তো এই ঘটনার অন্য কোনো অর্থও আছে। হয়তো এটাই পরবর্তী কোনো পদক্ষেপের সূচনা। আর্য্যক জানে না সেই পদক্ষেপ কী হবে, বা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। কিন্তু সে লড়তে প্রস্তুত।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
নর্মদার ঠান্ডা জল ভেঙে অন্য পাড়ে উঠে আর্য্যক প্রাণপণে দৌড়েছিল। ফুসফুস ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, পায়ের পেশীগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। পেছনে চিৎকারের শব্দ আর আগুনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার পরও সে থামেনি। সে জানত, বৃকাস কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে যখন তার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বিশেষ করে যখন সে জানতে পেরেছে আর্য্যক চারুলতা দিদার কাছে গিয়েছিল।
বনের গভীরে, যেখানে গাছের পাতা এত ঘন যে দিনের আলোও সহজে প্রবেশ করতে পারে না, এমন একটি জায়গায় আর্য্যক আশ্রয় নিল। জায়গাটা নিরাপদ, সহজে কারো চোখে পড়বে না। হাঁপাতে হাঁপাতে সে মাটির ওপর বসে পড়ল। সারা শরীর কাঁপছে। শুধু ঠান্ডায় নয়,adrenaline আর ভয়ের কারণেও।
কিছুক্ষণ পর শ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হলে সে কান পেতে রইল। কোনো শব্দ? ধাওয়াকারীদের পায়ের শব্দ? না। শুধু বনের নিজস্ব শব্দ— পোকার ডাক, ঝিঁঝির শব্দ, পাতার মর্মর। মনে হচ্ছে আপাতত সে তাদের এড়াতে পেরেছে।
কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না। চারুলতা দিদা! তার কী হলো? আর্য্যকের পালানোর সুযোগে তিনি কি পালাতে পেরেছেন? নাকি পাহারাদাররা যখন দেখেছিল আর্য্যক একা বেড়া ভেঙে বেরোচ্ছে, তখন তারা ভেতরে ঢুকে চারুলতা দিদাকে ধরে ফেলেছে? বৃকাস যদি জানতে পারে আর্য্যক চারুলতা দিদার সাথে কথা বলতে গিয়েছিল, তাহলে বৃদ্ধার ওপর কী নির্যাতন করবে সে, তা ভাবতেও গা শিউরে উঠল।
আর্য্যকের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। চারুলতা দিদাকে মুক্ত করা তো দূরের কথা, উল্টে তাকে আরও বড় বিপদে ফেলে এসেছে সে। তার হাতে সেই ফলটা আর শান্তিলতা— দুটোই আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই দুটো জিনিস মূল্যহীন মনে হচ্ছে। সেগুলো ব্যবহার করতে হলে তাকে আবার শৈলপ্রস্থে ঢুকতে হবে। কিন্তু কীভাবে? বৃকাস এখন আরও বেশি সতর্ক থাকবে। গ্রামের মানুষও তাকে ভয় পাচ্ছে, শত্রু মনে করছে।
হতাশা আর্য্যকের ভেতরটাকে গ্রাস করতে চাইছে। সে একা। তার বিরুদ্ধে শুধু বৃকাস নয়, পুরো গ্রামের ভয় আর অন্ধবিশ্বাস। তার কী করা উচিত এখন? পালিয়ে অন্য কোনো গ্রামে চলে যাবে? কিন্তু শৈলপ্রস্থ তার ঘর। সেখানকার মানুষ তার আপনজন। চারুলতা দিদা বন্দী, মৃগাঙ্ক বন্দী। সে তাদের ফেলে যেতে পারবে না।
কিন্তু লড়বেই বা কীভাবে? তার কাছে গ্রামের ভেতরের কোনো খবর নেই। চারুলতা দিদা বেঁচে আছেন কিনা, সেটাই সে জানে না। বৃকাস কি বলির তারিখ এগিয়ে এনেছে? কাকে বলি দেওয়া হবে? অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে সে।
সারাদিন আর্য্যক সেই গোপন জায়গায় লুকিয়ে রইল। খিদে পেয়েছে, কিন্তু বাইরে বেরোনোর সাহস নেই। সে কেবল চিন্তা করছে। তার হাতে থাকা ফল আর লতাটা দেখছে। ফলটা মিথ্যের প্রতীক। লতাটা আশার প্রতীক। আশা কিন্তু একা বেঁচে থাকতে পারে না, তাকে nurturance (লালন) দরকার, জ্ঞানের প্রয়োজন। সেই জ্ঞান চারুলতা দিদার কাছে।
বিকেল গড়িয়ে এল। বনের ভেতরের আলো ম্লান হয়ে আসছে। আর্য্যক জানে, এভাবে লুকিয়ে থাকলে কোনো লাভ হবে না। তাকে কিছু একটা করতেই হবে। তার প্রথম প্রয়োজন— খবর জোগাড় করা। জানতে হবে শৈলপ্রস্থের ভেতরে কী হচ্ছে।
কিন্তু কীভাবে? গ্রামের কাছে যাওয়া মানেই বিপদ। পাহারাদাররা নিশ্চয়ই আশেপাশের এলাকাগুলোতে খুঁজে দেখছে।
হঠাৎ তার মনে এল, গ্রামের মানুষজন জল আনতে কোথায় যায়? নদী থেকে। আর কাঠ কাটতে? বনের প্রান্তে। সেই জায়গাগুলো কি সে লুকিয়ে থেকে দেখতে পারে? হয়তো কোনো গ্রামবাসীর কাছ থেকে সামান্য কথা শুনতে পাবে। হয়তো চারুলতা দিদা বা মৃগাঙ্ক সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া যেতে পারে।
ঝুঁকি আছে, প্রচুর ঝুঁকি আছে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কিন্তু খবর না পেলে সে কোনো পরিকল্পনা করতে পারবে না। অন্ধকারে অন্ধের মতো লড়াই করা সম্ভব নয়।
সূর্য অস্ত গেল। চারিদিকে আঁধার নেমে এল। আর্য্যক তার গোপন আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এল। শরীর তখনও ক্লান্ত, কিন্তু মন স্থির। সে আবার শৈলপ্রস্থের দিকে রওনা দিল। এবার ভেতরে ঢোকার জন্য নয়, শুধু বাইরে থেকে দেখার জন্য। শোনার জন্য।
নদীর ধার দিয়ে খুব সাবধানে এগোতে লাগল সে। বাতাস ঠান্ডা। রাতের শব্দগুলো যেন আরও স্পষ্ট। দূরে শৈলপ্রস্থের আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলো তার কাছে এখন আর শান্তির প্রতীক নয়, সেটা মনে হচ্ছে যেন কোনো অন্ধকার রহস্যের আলোকময় কেন্দ্র।
আর্য্যক গ্রামের একেবারে কাছে পৌঁছাল। তবে বসতির ভেতরে ঢুকল না। বনের প্রান্তে লুকিয়ে রইল। যেখানে গ্রামের মানুষ কাঠ কাটতে আসে বা নদীতে জল আনতে যায়। রাতের অন্ধকারে এখানে সাধারণত কেউ থাকে না, কিন্তু সে অপেক্ষা করবে। ভোরের আলো ফোটার সময় গ্রামের মহিলারা জল আনতে আসে। হয়তো সেই সময় কোনো খবর পাওয়া যেতে পারে।
অপেক্ষা কঠিন। চারুলতা দিদার চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলছে। মৃগাঙ্কর অসহায় মুখটা মনে পড়ছে। বৃকাসের রাগী কণ্ঠস্বর তার কানে বাজছে।
তার হাতে ধরা থলিতে সেই কালচে ফল আর শান্তিলতা। এগুলো হয়তো বৃকাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার, কিন্তু সেই লড়াই শুরু করার জন্য তাকে আগে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে তথ্য জোগাড় করতে হবে।
(To be continued)